জনতা ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি পর্ব-১
দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে আটকা ৫ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা!
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০১:৪৪ এএম, ২৯ জুলাই,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ১০:০৫ এএম, ১১ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
ব্যাংকিং খ্যাতের যাবতীয় নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। ব্যাংকিং নীতিমালা উপেক্ষা করে গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডাইং লিমিটেড ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে আমদানিকৃত পণ্যে অনৈতিক সুবিধা দেয়ায় জনতা ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের করপোরেট শাখার ৫ হাজার ৬৩৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ২০১৬ সালের হিসাবের ওপর সরকারের একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
নথিপত্রে দেখা গেছে, ব্যাংকিং নীতিমালা উপেক্ষা করে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য নগদে আদায় না করে ডকুমেন্টস ছাড়করণ করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকের অনিয়মিত দায় সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া ডেফার্ড এলসির মাল রফতানি বা বিক্রয় সত্ত্বেও ঋণ হিসাবে জমা করা হয়নি। আবার ব্যাংকের মূলধনের নির্ধারিত সীমার বাইরেও ঋণ দেয়া হয়েছে।
এতে আরও দেখা গেছে, জনতা ভবন করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডাইং লিমিটেড ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রকল্প ঋণ মঞ্জুর করা হয়। পাশাপাশি ৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে সিসি হাইপো ঋণ মঞ্জুর করা হয়। গ্রাহকরা ঠিক সময়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হওয়ায় ১০টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অনুসন্ধানকালীন (অডিটকালীন সময়) পর্যন্ত পিসিআর ইস্যু করা হয়নি। ওই প্রতিষ্ঠানের দায়-দেনার বিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তাদের এলসি লিমিট দেয়া হয় ২৯০ কোটি টাকার। বিপরীতে পিএডি দায় সৃষ্টি হয় ৪৫০ কোটি ৭৫ লাখ টাকার। যা টার্মলোনে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে সীমার অতিরিক্ত এলসি স্থাপন করা হয়। একইভাবে সুপ্রভ স্পিনিং লিমিটেডের এলসি লিমিট ছিল ১৫০ কোটি টাকা। বিপরীতে পিএডি টার্মলোন হয় ১৭৮ কোটি ৯১ কোটি টাকা। ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে বর্তমানে পেমেন্ট এগেইনস্ট ডকুমেন্ট (পিএডি) ক্যাশ এলসি (এট সাইট) ৩ কোটি ৯১ লাখ, ডিমান্ড লোন ১৫৩ কোটি ৩৮ লাখ, ননফান্ডেড ১৪১ কোটি ৫১ লাখসহ মোট ২৯৮ কোটি ৮০ লাখ টাকার এলসি স্থাপন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ১৪৮ কোটি ৮০ লাখ টাকার অতিরিক্ত এলসি স্থাপন করা হয়।
জামানত ৪৩২ কোটি, ঋণ ৪ হাজার ৯৭৭ কোটি : মেসার্স গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডাইয়িং লিমিটেডের ৯০৩ কোটি ৭ লাখ টাকা ঋণের বিপরীতে জামানত আছে ২৯৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকার। ঋণের বিপরীতে জামানত ঘাটতি ৬১২ কোটি ৭১ লাখ টাকা। মেসার্স সুপ্রভ কম্পোজিট লিমিটেডের ঋণের দায় রয়েছে ৬২০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। জামানত আছে মাত্র ১২৪ কোটি ৯৮ কোটি টাকার। ঘাটতি ৪৯৫ কোটি ২৮ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পরিচালনা পর্ষদে পেশ করা স্মারকে দেখা যায়, গ্যালাক্সি সোয়েটার, সুপ্রভ কম্পোজিট নিট ও সিমরান কম্পোজিট লিমিটেডের তিনটি ঋণ ডিএফ ও বিএল (খেলাপি ঋণ) হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই নিয়মিত দেখিয়ে উপর্যুপরি এলসি স্থাপন করে অনিয়মিত দায় সৃষ্টি করা হয়েছে। যা ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১-এর পরিপন্থী। মঞ্জুরিপত্রের শর্তাবলীর ১১ (ক) অনুযায়ী যন্ত্রপাতি আমদানির ৬ মাসের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের শর্ত থাকলেও তা পালন করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক হতে প্রকল্প লোন পুনঃতফসিল করা হলেও শর্তানুসারে ২০১৭ সালের জুন হতে কিস্তি আদায়যোগ্য। কিন্তু গ্রাহক কোনও টাকা পরিশোধ করেনি। ৩টি চলমান প্রকল্পের ৩টি সিসি বা ক্যাশ ক্রাডিট (হাইপো) টার্মলোনে পরিণত করে ২০২১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত মেয়াদ প্রদান করা হয়েছে। সিসি হাইপো ঋণের কাঁচামাল দ্বারা উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি বা বিক্রয় করা সত্ত্বেও ঋণ হিসাবে জমা না করায় ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আলোচ্য গ্রাহক ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ঋণগুলো ২য় বার পুনঃতফসিলের জন্য ২০১৭ সালে পর্ষদের অনুমোদন ছাড়া পাঠানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তা অনুমোদন করেনি। পর্ষদের অনুমোদন ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে পুনঃতফসিলের জন্য পাঠানা গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হিসেবেই ধরা হয়। ঋণগুলো শ্রেণিকৃত ঋণ হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংক ঋণগুলোকে নিয়মিত দেখিয়ে এলসি স্থাপনের সুবিধা দিয়েছে। এটিও ব্যাংকের বিধি-বিধানের পরিপন্থী। জনতা ব্যাংক লিমিটেডের ২০১৬ সালে মোট মূলধন ছিল ৪ হাজার ৩১৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) শর্তানুসারে কোনও একক গ্রাহক বা গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংকের মোট মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়া যাবে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঋণের স্থিতি রয়েছে (ফান্ডেড) ৪ হাজার ৯৭৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। অপরদিকে ওই সময় ব্যাংকটির ননফান্ডেড দায় ৬৫৭ কোটি টাকা। এমওইউর শর্তানুসারে ব্যাংকের মূলধনের ৫ শতাংশের বেশি ননফান্ডেড দায় রাখা যাবে না। এক্ষেত্রেও স্মারকের শর্ত না মেনে ৪৪১ কোটি ৫৪ লাখ টাকার অতিরিক্ত ননফান্ডেড দায় তৈরি করা হয়েছে।
মেসার্স গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডাইং লিমিটেডের অনুকূলে ১৪৫টি ক্যাশ এলসি (এট সাইট) স্থাপন করা হয়। এলসির পেমেন্ট চুক্তির নথি (পিএডি) বাবদ দায় ১৮১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা নগদে আদায় না করে ডকুমেন্টস ছাড়করণ করায় ব্যাংকের অনুকূলে অনিয়মিত দায় হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি শীর্ষ ৩০০ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি। একইভাবে সুপ্রভ স্পিনিংয়ের ৪টি, সুপ্রভ কম্পোজিট লিমিটেডের অনুকূলে ৩৬টি, সুপ্রভ রোটর স্পিনিংয়ের অনুকূলে ২টি এবং সিমরান কম্পেজিট লিমিটেডের অনুকূলে ১টি ক্যাশ এলসির পিএডিসহ মোট ১৫৪ কোটি ৬০ লাখ টাকার পিএডি দায় আদায় না করেই ডকুমেন্ট ছাড় করা হয়েছে। এটিও নীতিমালা বিরুদ্ধ। গ্রাহক ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে এক হাজার ৩৪৮ কোটি ৫২ লাখ টাকার পিএডি ও ডিমান্ড লোনের মালামাল আমদানি করা হয়। উক্ত টাকার মালামাল বিক্রি করা সত্ত্বেও গ্রাহক ঋণের টাকা জমা করেনি। বরং অনবরত আমদানি এলসি স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাংকের ক্ষতি করে গেছে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১৬৫টি সাইট এলসি ও ডেফার্ড এলসি স্থাপন করা হয়েছে যার মূল্য ৩৭৪ কোটি ৭১ কোটি টাকা। এই এলসির দায়ও যে কোনও সময় ফান্ডেড ঋণে পরিণত হবে। গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডাইং লিমিটেড ৪ বছরে প্রায় ২ হাজার ২৫২ কোটি টাকা আমদানির বিপরীতে ৪৮১ কোটি ৩৬ লাখ টাকার রফতানি করেছে। আমদানির তুলনায় যা প্রায় এক হাজার ৭৭০ কোটি টাকা কম। এ আমদানির এলসি জনতা ব্যাংক ভবন করপোরেট শাখা হতে করা হয়েছে। অথচ গ্রাহক জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে রফতানি কার্যক্রম পরিচালনা করে না এবং বিক্রয়লব্ধ টাকা ঋণ হিসাবে জমা করেনি। এলসি মূল্য নগদে আদায় না করে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক পুনঃতফসিলকরণের মাধ্যমে মেয়াদী ঋণে পরিণত করা ব্যাংকের আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। সুপ্রভ স্পিনিং মিলস লিমিটেড ও সুপ্রভ রোটটের সিসি ঋণ হিসাবে সীমার অতিরিক্ত দায় আদায়ে কোনও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। উল্টো ক্রমাগত ডেফার্ড এলসি স্থাপন করে দিনদিন দায় বাড়ানো হয়েছে।
অনিয়মের কারণ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য নগদে আদায় না করে ডকুমেন্টস ছাড়করণ, সমঝোতা চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন, নীতিমালা ভেঙে পিএডিকে টার্মলোনে রূপান্তর, পর্যাপ্ত সহায়ক জামানত থাকা, লিমিট অতিরিক্ত এলসি স্থাপন করায় এ অনিয়ম হয়েছে। এতে একক ঋণ দানে ব্যাংকের পেইড আপ ক্যাপিটালের সীমা অতিক্রম করেছে। ক্রমশ ব্যাংকের দায় বেড়েছে ও ঋণ আদায়ের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এসব বিষয়ে জনতা ব্যাংক বলেছে, গ্যালাক্সি সোয়েটার ও সুপ্রভ স্পিনিংয়ের অনুকূলে তৈরি পিএডি বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা ও অনাপত্তির আওতায় টার্মলোনে রূপান্তর করা হয়েছে। কোম্পানিগুলোর সহজামানত ১:১ এ উন্নীত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কয়েকটি প্রকল্পের অবকাঠামোগত ত্রুটি থাকায় ওই প্রকল্পের পিসিআর ইস্যু করা যায়নি। এ কাজ চলমান আছে। জনতা ব্যাংকের এই জবাব গ্রহণযোগ্য নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এমওইউর শর্ত লংঘন করে অনবরত দায় সৃষ্টি করে ব্যাংকের ক্ষতি করা হয়েছে। তাছাড়া পিএডির টাকা নগদে আদায় না করে টার্মলোনে রূপান্তর করা, সিসি (হাঃ) ঋণকে টার্মলোনে রূপান্তর করা ও পিসিআর ইস্যু না করা ব্যাংক নীতিমালার পরিপন্থী। সহজামানত না বাড়িয়ে সীমার বাইরে এলসি খোলার অনুমোদন প্রদান করায় ব্যাংকের ক্ষতিও হয়েছে। এ অনিয়মের বিষয়ে ২০১৮ সালের ২৮ জুন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর অগ্রিম অনুচ্ছেদ জারি করা হয় এবং ৮ আগস্ট তাগিদপত্র দেয়া হয়। জবাব না পাওয়ায় ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ সচিব বরাবর আধাসরকারি পত্র দেয়া হলেও জবাব পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় অনিয়মের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে আপত্তিতে জড়িত টাকা আদায় করা জরুরি বলা হয়েছে। অনাদায়ী অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে অনিয়মে জড়িত প্রকৃত অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ করাও জরুরি বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ বিষয়ে জানতে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুছ ছালাম আজাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস পাঠালেও সাড়া দেননি।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যাংকিংয়ের পুরো ব্যবস্থাকে জিম্মি করে ফেলা হয়েছে। এক্ষেত্রে যারা ঋণখেলাপি তাদের পক্ষেই আবার আইন সংশোধন করা হয়েছে। তাদেরকে বারবার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। জনতা ব্যাংকও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন। এই ব্যাংকেরও নীতিমালা রয়েছে যা পালন করা হয় না।
তিনি আরও বলেন, পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়া তো এমনটা হতে পারে না। অসাধু ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একাংশের যোগসাজশে এমন কাজ করে। বোর্ড সদস্যদের মধ্যেও এই যোগসাজশ রয়েছে। ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকিরও অভাব রয়েছে। ব্যর্থতার দায় তাদেরও নিতে হবে।