ব্যাংকে না গিয়েও তাদের নামে ঋণ!
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৩৬ এএম, ১০ আগস্ট,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৩৫ এএম, ৫ সেপ্টেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
হঠাৎ করে ব্যাংক থেকে ফোন দিয়ে কৃষি ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। ঋণ পরিশোধ না করলে মামলার হুমকি দিয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। এ ঘটনার পর থেকে ঋণ উত্তোলন না করেও এখন দেনাদার হওয়া কৃষকদের মাঝে চরম হতাশা ও মামলার আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ নিয়ে বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, কৃষি ঋণের নামে ব্যাপক হরিলুট করা হয়েছে সোনালী ব্যাংক বরিশালের সাহেবেরহাট শাখায়। চিহ্নিত কয়েকজন দালালের মাধ্যমে ব্যাংকের কতিপয় কর্মকর্তা ভুয়া জমির পর্চা, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট, জামিনদার, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, ছবি, ভুয়া স্বাক্ষর ও টিপ সই দিয়ে গ্রামের সহজ সরল মানুষের নামে বছরের পর বছর ঋণ বিতরণ দেখিয়ে পুরো টাকা আত্মসাৎ করে নিয়েছেন। অধিকাংশ গ্রাহক জানেন না ব্যাংক ঋণের বিষয়ে। আবার কেউ কেউ দালালের খপ্পরে পরে ঋণের টাকার নামেমাত্র টাকা হাতে পেয়েছেন। যাচাই বাছাই না করেই দালালের মাধ্যমে কতিপয় ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজশে কিভাবে এমন ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সচেতন নাগরিকরা।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার মো. আল-আমিন গাজী জানান, তার নামে ব্যাংক ঋণ হয়েছে অথচ তিনি কখনও ব্যাংকের ধারে কাছেও জাননি। ২০১৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তাকে চরকাউয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা দেখিয়ে (০৩৩১৯৬২০০০২৬৪) নম্বর ঋণ একাউন্টে জমির ভুয়া পর্চা, ভুয়া জামিনদার আর ভুয়া স্বাক্ষর করে তার নামে ২০ হাজার টাকা ঋণ উত্তোলন করা হয়। অথচ ভূমিহীন হওয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে তাকে ঘর দেয়া হয়েছে। তার নামে কোনো জমি নেই দাবি করে আল-আমিন আরও জানান, কিভাবে তার নামে ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে তা তিনি নিজেও জানেন না।
তিনি বলেন, অতিসম্প্রতি ব্যাংক ম্যানেজার নজরুল ইসলাম তাকে ফোন করে ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেয়া হয়। এরপর থেকে তিনি জানতে পারেন তার নামে ব্যাংক থেকে ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে। মো. সালাম গাজী নামের অপর এক গ্রাহক জানান, ২০১৬ সালে (০৩৩১৯৬২০০০১৭৪) লোন হিসেব নম্বরে তার নামে ২৪ হাজার টাকা ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে। শতকরা নয় ভাগ মুনাফাসহ বর্তমানে যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৮৫৩ টাকা। অথচ অক্ষরজ্ঞানহীন সালাম গাজী ঋণের বিষয়ে কিছুই জানেন না। ৭৩-৮৩৩ হিসেব নম্বরের গ্রাহক মো. ফারুক সরদার জানান, তিনি অক্ষরজ্ঞানহীন। ব্যাংকে না গেলেও তার নামে কিভাবে ঋণ হয়েছে এ নিয়ে বর্তমানে তিনি মহাদুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন।
তিনি আরও জানান, সম্প্রতি তাকে ব্যাংকের নিচে দাঁড় করিয়ে দালাল নজরুল ইসলাম একটি কাগজে তার একটি টিপসই নেয়। পরে দালাল নজরুল তাকে দুই হাজার টাকা হাতে দিয়ে বলে তোমাকে সাহায্য করা হয়েছে। সম্প্রতি ব্যাংক ম্যানেজারের ফোন পাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন, তার নামে ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে।
ফারুক সরদার জানান, ব্যাংক কর্মকর্তারা তাকে না দেখে তার একটি টিপ সইতে কিভাবে ঋণ দিয়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদর ইউনিয়নের চরকাউয়া এলাকার চিহ্নিত দালাল নজরুল ইসলাম এবং বাকেরগঞ্জের চরাব্দি এলাকার আলতাফ গাজী নামের দুই দালালের সহযোগিতায় তৎকালীন ব্যাংক ম্যানেজার এবং লোন কর্মকর্তারা ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে ভুয়া নাম দিয়ে কৃষি ঋণের টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। দালালের মাধ্যমে ঋণের নামে প্রতারণার শিকার হওয়া ওই শাখার অসংখ্য গ্রাহকরা একই অভিযোগ করেছেন।
এ ব্যাপারে তৎকালীন ব্যাংক ম্যানেজার (বর্তমানে উজিরপুর শাখায় কর্মরত) মহসিন হাওলাদার বলেন, এমন ভুল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। যদি হয় তবে ম্যানেজার হিসেবে দায়ভারতো আমাকেই নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, মেহেদী আল মিরাজ নামের এক কর্মকর্তা গ্রাহকদের শনাক্ত করার পর ঋণ বিতরণ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামের সুপারিশে সর্বশেষ আমি স্বাক্ষর করেছি। নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে ঋণ বিতরণ কর্মকর্তা (বর্তমানে বরিশাল নগরীর বগুড়া রোড শাখায় কর্মরত) রফিকুল ইসলাম বলেন, এমন অনিয়ম হতেই পারে না। যারা অভিযাগ করেছেন তারা মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ করেছেন।
সোনালী বাংকের ডিজিএম আবু বকর সিদ্দিক জানান, বিষয়টি শুনে তিনি সাহেবেরহাট শাখা থেকে সব কাগজপত্র এনে যাছাই বাছাই করছেন। কোনো সমস্যা পেলে অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা ঘটনার সাথে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বরিশালের উপ-পরিচালক দেবব্রত মন্ডল বলেন, বিষয়টি নিয়ে এখনো কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে ঘটনাটি গুরুতর অপরাধ। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।