১৪৫ কোটি টাকা খরচের পর বাতিল হলো প্রকল্প
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:০৯ এএম, ৩১ আগস্ট,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ১০:০৪ পিএম, ৫ সেপ্টেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
উত্তরাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ সহজ করতে গাইবান্ধার বালাসীঘাট থেকে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত ফেরি রুট নির্মাণ করা হয়। দুই দফায় প্রকল্পটির ব্যয় বাড়িয়ে গত জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। অপেক্ষা ছিল উদ্বোধনের। কিন্তু হঠাৎ জানানো হলো, এই পথ ফেরি চলাচলের উপযোগী নয়। ফলে গচ্চা গেল সরকারি ১৪৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। ড্রেজিং, দুই ঘাটে টার্মিনাল এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে ত্রæটি আছে জানিয়ে এই নৌ রুটটি ফেরি চলাচলের উপযোগী নয় বলে প্রতিবেদন দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএর কারিগরি কমিটি। ফলে এমন সংবাদে ক্ষোভ আর হতাশা বিরাজ করছে নদীবেষ্টিত যমুনার দুই পাড়ের মানুষের মাঝে। ‘সরকারের এতগুলো টাকা গচ্চা গেল, ভাবতেই অবাক লাগে। এই টাকার মধ্যে তো আমাদের করের টাকাও আছে। বাংলাদেশ এমনিতেই গরিব দেশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই ভাবা উচিত ছিল’। বৃহত্তর রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কয়েক জেলার যোগাযোগের দূরত্ব কমাতে এই নৌরুট চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর চাপ কমানো ছিল মূল উদ্দেশ্য। চলতি বছরের জুনে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (সেক্টর-৮) এই প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষা প্রতিবেদনে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পর্কিত কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে। কিন্তু সংস্থাটির ড্রেজিং বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদারকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি চলতি বছরের এপ্রিল ও মে মাসে সরেজমিনে দুটি ঘাট পরিদর্শন করে সম্প্রতি এই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এক সময় উত্তরাঞ্চলের মানুষের ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র পথ ছিল বালাসীঘাট-বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট। নৌপথে যোগাযোগের জন্য এই ঘাটের নামডাক ছিল দেশজুড়েই। কিন্তু নাব্যসংকট ও যমুনা নদীর গতিপ্রকৃতি বদলে যাওয়াসহ বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর পর ২০০৫ সালের ১৫ জুন বন্ধ হয়ে যায় এই ফেরি ঘাটটি। এরপর থেকে যমুনা নদীর দুই পাড়ের মানুষের যোগাযোগের একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ায় ইঞ্জিনচালিত ছোট বড় নৌকা। প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার মানুষ নৌকায় নদীপথে চলাচল করে আসছে। এতে পণ্য পরিবহনসহ যেকোনো প্রয়োজনে যাতায়াতে নৌকায় গুনতে হতো বেশি ভাড়া। যোগাযোগের সেতুবন্ধের এই ঘাটটি যমুনার দুই পাড়ের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ছিল আবারও ফেরি চলাচলে।
২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে একনেকের এক সভায় বালাসীঘাট থেকে বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত নৌ রুটটি আবারও চালু করে ফেরি ঘাট নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পটির প্রথম ব্যয় ধরা হয়েছিল তখন ১২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। পরবর্তী সময়ে দুবার সংশোধন করে প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ১৪৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা খরচ করে বাস টার্মিনাল, টোল আদায় বুথ, পুলিশ ব্যারাক, ফায়ার সার্ভিস ও আনছার ব্যারাকসহ বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএর কারিগরি কমিটি হঠাৎ করে নাব্যসংকট ও ২৬ কিলোমিটার বিশাল দূরত্বের নৌপথসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে নৌ রুটটি চলাচলে অনুপযোগী বলে প্রতিবেদন দেয়। এতে এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই কাজ শুরু এবং শেষ পর্যায়ে এসে ফেরিঘাট প্রকল্পটি বাতিলের এমন সিদ্ধান্তে বিআইডব্লিউটিএর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বালাসী ঘাট এলাকার বাবু মিয়া বলেন, সরকারের ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয় করার আগে ভালোভাবে সমীক্ষা করা দরকার ছিল। গাইবান্ধার মানুষের উন্নয়নের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। এই অঞ্চলের মানুষ এখন হতাশাগ্রস্ত। এ জন্য বিআইডব্লিউটিএকে দায়ী করেন তারা। মেহেদী হাসান বাবু নামে একজন বলেন, ফেরি চলাচল হলে এই এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন আসত। শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটত। এতে বেকারত্ব ঘুচত। এখন কিছুই হলো না। মূলত গাইবান্ধার মানুষের সঙ্গে একপ্রকার প্রতারণা করা হলো। বিআইডব্লিউটিএর কারণে এই প্রকল্পে ক্ষতি হয়েছে। প্রকল্পটি পুনর্বিবেচনা করে এখানে যাতে ফেরি চলাচল হয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি করেন তিনি। বালাসীঘাটে ঘুরতে আসা সোহেল রানা নামের এক দর্শনার্থী বলেন, সরকারের এতগুলো টাকা গচ্চা গেল, ভাবতেই অবাক লাগে। এই টাকার মধ্যে তো আমাদের করের টাকাও আছে। বাংলাদেশ এমনিতেই গরিব দেশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই ভাবা উচিত ছিল। স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ী মতিন মিয়া বলেন, গাইবান্ধার মানুষ এখন হতাশ। আমাদের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। অনেক আশা ছিল বালাসীঘাট দিয়ে ফেরি পারাপার হবে। এতে বেচাবিক্রি বেশি হবে। সংসারে সচ্ছলতা ফিরবে। আমাদের এই আশাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। কী কারণে ফেরি চলাচল বন্ধ হলো সরকারই তা ভালো জানে। বিআইডব্লিউটিএর কারিগরি কমিটির এই সিদ্ধান্তে প্রশ্ন তুলেছেন জেলার সামাজিক আন্দোলনের নেতারা।
তারা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত হঠকারিতা ও সরকারের অর্থ লুটপাট এবং জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। লুটপাটের তদন্তসহ জড়িতদের বিচারের দাবিও জানান তারা। গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চের সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, আমরা মনে করি রাষ্টীয় ১৪৫ কোটি টাকা বিআইডব্লিউটিএ লুট করে বাংলাদেশ তথা গাইবান্ধার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা করেছে। এই লুটপাটের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার হোক পাশাপাশি অবিলম্বে বালাসী-বাহাদুরাবাদ ফেরি সার্ভিস চালু করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বালাসীঘাটের ফেরিঘাটটি এই অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি ছিল। এটি চালুর স্বপ্নের আশায় বুক বেঁধেছিল যমুনার দুই পাড়ের মানুষ। সরকার অধিকতর তদন্ত করে পুনরায় এই রুটে ফেরি সার্ভিস চালু করবে, এমনটা প্রত্যাশা করে এই অঞ্চলের মানুষ।