রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সঙ্কট
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:৩২ পিএম, ১০ জুন,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০৪:২৬ পিএম, ৮ অক্টোবর,মঙ্গলবার,২০২৪
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেট উপস্থাপন করেছেন এমন সময়, যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্য বেড়ে গেছে, শস্য এবং খাদ্যসহ আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতি বাড়ন্ত, ডলারের বিনিময় হারে অস্থিরতা এবং রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যাওয়াসহ সব মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতি নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে।
বাজেট প্রস্তাবনার শুরুতেই আগামী অর্থবছরে অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিকে।
বাজেট বক্তৃতায় জানানো হয়, গুরুত্বপূর্ণ নয়টি পণ্য আমদানি করতে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সম্ভাব্য ৮.২ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত ব্যয় হবে।
বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়, এ প্রেক্ষাপটে বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ইমপোর্টেড ইনফ্লেশন হিসেবে অভ্যন্তরীণ বাজারের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা।
অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট নেটওয়ার্ক সুইফট হতে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করায় সার্বিকভাবে রাশিয়ার আমদানি-রফতানি বাণিজ্য সঙ্কুচিত হয়ে আসছে, যা বৈশ্বিক সাপ্লাই-চেইনকে ব্যাহত করছে।
বাজেট বক্তৃতায় বলা হচ্ছে, যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ৮৫ শতাংশ বেড়েছে।
বাংলাদেশ সরকারি হিসেবে, বর্তমানে সার্বিক মূল্যস্ফীতি রয়েছে ৬.২৯ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে সেটি ৫.৬ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখার কথা বলা হয়েছে।
বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে সরকার বিরাজমান চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে সরবরাহ বাড়ানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।
বাজেট বক্তৃতা থেকে বোঝা যায়, মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখতে খাদ্য ও কৃষি-জ্বালানি খাতে প্রণোদনা ও ভর্তুকি অব্যাহত রাখার চেষ্টা থাকবে।
বাজেটে প্রস্তাবিত মোট ভর্তুকি ও প্রণোদনা রাখা হয়েছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে কৃষিতে ১৫ হাজার কোটি, খাদ্যে ছয় হাজার ৭৪৫ এবং বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে ১৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাস ও সারের মূল্যের সাম্প্রতিক যে গতিপ্রকৃতি, তাতে ভর্তুকি ব্যয় আরো ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে যা আগামী অর্থবছরের বাজেট ব্যবস্থাপনায় একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
ভর্তুকি দেয়ার পরেও সার ও বিদ্যুৎ-গ্যাস এবং তেলের দাম বাড়ানো হতে পারে বলে ইঙ্গিত রয়েছে বাজেটে।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলার কৌশল উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সার্বিকভাবে সরকারের মূল কৌশল হবে বিদ্যমান চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে সরবরাহ বাড়ানো। এ লক্ষ্যে আমদানিনির্ভর ও কম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যয় বন্ধ রাখা অথবা হ্রাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের দাম পর্যায়ক্রমে ও স্বল্প আকারে সমন্বয় করা হবে। রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম জোরদার করা হবে।
তিনি বলেন, মূল্য সংযোজন কর ও আয়করের নেট বাড়ানো হবে। অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা হবে। আন্ডার ওভার ইনভয়েসিংয়ের বিষয়টি সতর্ক পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।
বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়, ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার প্রতিযোগিতামূলক রাখা হবে। করোনা মহামারীর মতো ইউক্রেন সঙ্কট পরিস্থিতি মোকাবেলা করে দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হবে।
তবে সরকারি আয়-ব্যয়ের ঘাটতি মেটাতে শতভাগ মূল্য জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হবে না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ব্যয় বেড়েছে ও রেমিটেন্স কমে যাওয়ায় রিজার্ভ কমে ৪২.১ বিলিয়ন ডলারে এসেছে।
বাজেটের প্রস্তাবনায় রেমিটেন্স বাড়ানোর জন্য বিদেশ থেকে পাঁচ হাজার ডলার পর্যন্ত আনার ক্ষেত্রে অর্থের উৎস জানতে না চাওয়া এবং বিদেশ থেকে টাকা পাঠালে নগদ ২.৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়া অব্যাহত রাখার কথা বলা হয়েছে।
বাজেট প্রস্তাবনায় এছাড়া বিদেশে থাকা অর্থ-সম্পদ দেশে আনার লক্ষ্যে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন বিধান সংযোজনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। যেখানে আগামী অর্থবছরে ৭-১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করে বিদেশে অবস্থিত যেকোনো সম্পদ দেশে আনলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ যেকোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করবে না।
যুদ্ধের প্রভাবে ডলারের মূল্য অস্থিরতার বিষয়টিও বাজেট বক্তৃতায় প্রাধান্য পেয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে ৭.৯ শতাংশ।
স্থানীয় বাজারে মার্কিন ডলারের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্কট মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ডলার সরবরাহ করছে, প্রয়োজনে সেটি অব্যাহত থাকবে।
রফতানি উৎসাহিত করতে টেক্সটাইল শিল্পে বিদ্যমান ১৫ শতাংশ কর ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে।
ব্যাংক সুদে উৎসে কর ১০ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ এবং রফতানি পণ্যে উৎসে কর .৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে।
কোভিড পরবর্তী চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্কটের মধ্যে প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছেন ৭.৫ শতাংশ।
তবে বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করা হয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে করোনা মহামারী পরবর্তীকালের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে।
সূত্র : বিবিসি