বিশ্ববাজারে কমলেও বাংলাদেশে কেন আটা বা গমের দাম বাড়ছে?
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:০৪ পিএম, ৫ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৪৯ পিএম, ৭ অক্টোবর,সোমবার,২০২৪
আন্তর্জাতিক বাজারে গত কয়েক মাসে গমের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। বরং গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের বাজারে আটা ও রুটির দাম বেড়েই চলেছে। জুন মাসেও ঢাকার বাজারে এক কেজি আটা ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা ৬০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে গমের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশের একজন গম আমদানিকারক কে এইচ এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার খোরশেদ আলম দাবি করছেন, ‘আমরা আগে যে দামে গম কিনেছি, এখন সেগুলো আসছে। নতুন দামের গমের এলসি আমি এখনো খুলি নাই, অনেকেই খোলে নাই। সেগুলো বাজারে এলে তখন হয়তো আমরা কম দামে বিক্রি করতে পারবো। ‘বাংলাদেশে প্রতি বছর গমের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৭৫ লাখ টন। এর মধ্যে ১০ থেকে ১৫ লাখ টন দেশে উৎপাদিত হয়, বাকিটা আমদানি করতে হয়। আমদানির বেশিরভাগটা রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে করা হতো। কিন্তু সেখানে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রফতানি বন্ধ হয়ে গেলে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বাড়তে শুরু করে। ফলে বাংলাদেশের আমদানিকারকরাও বেশি দাম দিয়ে বুলগেরিয়া, রোমানিয়া থেকে গম আমদানির চেষ্টা করেন। তবে ডলারের বিপরীতে টাকার দর পড়ে যাওয়ার কারণে সেটিও গমের দাম বৃদ্ধিতে বাড়তি উপাদান যোগ করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে গমজাত খাদ্যপণ্য ও বেকারি আইটেমের দাম রাতারাতি বেড়ে যায়। খোলা আটার কেজিও ৩০ টাকা থেকে এখন ৬০ টাকায় উঠেছে।
খোরশেদ আলম বলেন, ‘ডলারের দামও তো এখন আগের অবস্থায় নেই। আগে আমরা ৮৫ টাকা দরে ডলার কিনতাম, এখন সেটা ১০৫ টাকা হয়েছে। ফলে চাইলেও আগের দামে আর হয়তো ফিরে যাওয়া যাবে না। কিন্তু নতুন করে যেসব গমের এলসি হবে, সেগুলো দেশে আসতে শুরু করলে দেশের বাজারেও দাম কিছুটা অবশ্যই কমবে।’
গমের দামের বৃদ্ধি ও হ্রাস: ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে গম ও ভোজ্যতেলের মতো খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। কারণ বাংলাদেশের গমের চাহিদার বড় অংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। তবে অক্টোবরের প্রথম দিকে কৃষ্ণসাগর থেকে খাদ্যপণ্য রফতানির চুক্তি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমতে শুরু করেছিল। পরবর্তী সময়ে ওই চুক্তি থেকে রাশিয়া সরে আসার ঘোষণা দেয়ার পর গমের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছিল। তবে কিছুদিন পরেই রাশিয়া কৃষ্ণসাগর থেকে খাদ্যপণ্য রফতানি করতে দেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর আবার দাম কিছুটা কমে আসে। সেইসাথে রাশিয়ায় গমের বাম্পার ফলন হওয়ার ঘোষণা আসার পর থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমতে শুরু করেছে। শুক্রবার শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে প্রতি টন গম লেনদেন হয়েছে ২৭৯.৬২ ডলার দরে। অক্টোবর মাসেও এই দর ছিল ৩৯৫ ডলার। ব্যবসায়ীরা ধারণা করছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের গম বিশ্ববাজারে আসার পর গমের দাম আরো কমতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমলেও তার কোনো প্রভাব দেখা যায়নি বাংলাদেশের বাজারে। আন্তর্জাতিক বাজারে দমের দাম বেড়ে যাওয়ার পর আটা ও গমজাত খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়েছিল বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমলেও তাতে আটা, রুটি বা এ জাতীয় পণ্যের দাম কমবে কিনা, সেটি নিশ্চয়তা দিতে পারছে না ব্যবসায়ীরা।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে প্রতি কেজি আটার তুলনায় এই বছরের নভেম্বরে ৬৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সময় প্রতি কেজি আটার দাম ছিল ৩২ টাকা, যা এখন ৬০ টাকা পার হয়ে গেছে। আটা বা ময়দা দিয়ে তৈরি যে রুটি বা পরোটা ছয় মাস আগেও বিক্রি হতো আট টাকা বা দশ টাকা দরে, সেটির দাম এখন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সেইসাথে পাউরুটি, বিস্কুট বা বেকারি আইটেমের কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাম বেড়েছে। আবার কোনো কোনো পণ্যের দাম আগের মতো রাখা হলেও আকার কমিয়ে দেয়া হয়েছে। বড় আমদানিকারকরা এ জন্য দায় চাপাচ্ছেন খুচরা ব্যবসায়ীদের ওপরে। অন্যদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা আঙ্গুল তুলছেন গমের পাইকারির চড়া দামের ওপরে।
গম আমদানিকারক খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমরা তো গম এনে পাইকারি বিক্রি করি। তারপরে সেটা খুচরা বাজারে বিক্রি হয়। সেখান থেকে আবার আটা তৈরি হয়। এরপরে অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য তৈরি হয়। ফলে আমরা কম দামে বিক্রি করলেও তাতে বাজারে আটার দাম কমবে কিনা, সেটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে,’ বলছিলেন তিনি। তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাইলেই তাদের পক্ষে আটার দাম কমানো সম্ভব নয়। কারণ তারা এটি পাইকারি কিনে এনে সামান্য লাভে বিক্রি করেন।
ঢাকার কাঠালবাগানের একজন মুদি দোকানী মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা যে দামে গম পাই, সেটা ভাঙ্গিয়ে অথবা আটা কিনে সামান্য লাভে বিক্রি করি। গমের দাম বাড়লে আমাদের বেশি দামে বিক্রি করতে হয়, আর কমলে আমরা কম দামে বিক্রি করতে পারি। কিন্তু পাইকারিতে দাম না কমলে তো আমরা কিভাবে বিক্রি করবো? অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে যখন কোনো পণ্যের দাম বাড়ে, বাংলাদেশের বাজারেও রাতারাতি দাম বেড়ে যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে তার প্রভাব সহজে দেখা যায় না।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো অস্বাভাবিকভাবে মুনাফা করার চেষ্টা করে। ফলে তারা অনেক সময় কম দামে খাদ্যপণ্য কিনলেও বাজারে সেটা কম দামে বিক্রি করেন না। সরকারও এক্ষেত্রে যথাযথ নজরদারি করতে পারছে না। অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে।
তিনি বলেন, এটা হয়তো স্থানীয় বাজারে যেসব পণ্য আছে, অর্থাৎ স্টকে যেটা আছে, সেটা হয়তো আগের দরে কেনা, বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে মেলে না। ‘তবে বাংলাদেশে এটা একটা সাধারণ প্রবণতা, বিশ্ববাজারে বাইরে বাড়লে তারা সাথে সাথে বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আমদানির ক্ষেত্রে কমলেও তারা অপেক্ষা করে কবে কম দামের পণ্যটা বাজারে আসবে। ফলে কম দামের সুফল পেতে হয়তো সময় লেগে যায়। আমাদের দেশে অনেক বাণিজ্য নীতিমালা, নিয়মকানুন বা আইন থাকলেও অনেক সময় সেটার ঠিকমতো প্রতিফলন হয় না। গম বা চালের কথাই বলুন না কেন, কিছু ব্যবসায়ী এটা নিয়ন্ত্রণ করেন। নানা নামে প্রতিষ্ঠান থাকলেও এখানে অনেকটা একচেটিয়া ব্যবসা রয়েছে। ফলে বাজারটা প্রতিযোগিতামূলক নয়। তাই কেউ কম দামে কিনলেও সেটা আর কম দামে বাজারে আসে না। সরকারও এসব আইনের কড়াকড়ি তেমন করে না,‘ বলছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। সেইসাথে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা আর এক্সচেঞ্জ রেটেও ওঠানামার কারণেও বিশ্ববাজারে কেনা পণ্যের দাম দেশীয় বাজারের প্রতিফলন হতে সময় লাগে বলে তিনি মনে করেন।