

বাজারে আগুন : পুড়ছে সাধারণ ক্রেতা
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২:০৪ এএম, ৬ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ১১:৫৫ এএম, ২৯ মে,সোমবার,২০২৩

সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলায় ভরপুর বাংলাদেশ আজ শ্রীহীন হয়ে পড়ছে। অভাব ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে আজকের জনজীবন দুঃখ ও হাহাকারে পূর্ণ। মানুষের ওপর চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঘোটক। জীবনধারণের উপযোগী প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্য। চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি, লবণ, গম, আটা, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি দ্রব্যের মূল্য আগের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী, পণ্যের সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে আর সরবরাহ বাড়লে দাম কমে। কিন্তু বাংলাদেশে সব সময় এই নিয়ম খাটে না। বর্তমানে বাজারে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে, কোনোটির সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের উৎপাদন ও আমদানি বেড়েছে। সরবরাহ ব্যবস্থাও স্বাভাবিক। ফলে মোকাম থেকে পাইকারি ও খুচরা বাজারে ভরপুর রয়েছে সব ধরনের পণ্য। তারপরও আসন্ন রমজান উপলক্ষে রোজানির্ভর পণ্যসহ একাধিক পণ্যের দাম হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে। দুই মাস আগে বেড়ে যাওয়া ছোলা, ডাল, চিনি, দুধ, মাছ ও সব ধরনের মাংস বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া দেশে করোনার বিস্তার রোধে সরকারের লকডাউনের খবরে বাজারে ক্রেতাদের ভিড় বাড়ায় দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ভোক্তারা পড়েছেন বিপাকে।
বর্তমানে করোনার প্রভাবে কর্মহীন মানুষ। কাঁচাবাজারের লাগামহীন মূল্যে নিম্ন আর মধ্যম আয়ের মানুষের জীবন এখন বিপর্যস্ত। সবজি কেনা এখন দুরূহ ব্যাপার। তাই ডাল আর ডিমের ওপরই ভরসা প্রত্যন্ত এলাকার খেটে খাওয়া পরিবারগুলোর। বর্তমানে প্রতিটি সবজি কেজিপ্রতি দুই থেকে চার গুণ দামে কিনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) জানিয়েছে, নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখতে এ বছর ভর্তুকিমূল্যে পণ্য বিক্রি কার্যক্রম বাড়িয়েছে টিসিবি। রমজানে যেসব পণ্যের বেশি চাহিদা থাকে সেগুলোর ১০ থেকে ১২ শতাংশ টিসিবির মজুত রয়েছে। সেক্ষেত্রে রমজান উপলক্ষে সংস্থাটি সাশ্রয়ী মূল্যে ২৬ হাজার ৫০০ টন ভোজ্যতেল, ১৮ হাজার টন চিনি, ১২ হাজার টন মসুর ডাল, ৮ হাজার টন ছোলা ও ৬ হাজার টন পেঁয়াজ বিক্রি করবে, যা গত বছরের চেয়ে বেশি। এসব পণ্য এখন বিক্রি চলছে।
টিসিবি সর্বশেষ তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত এক বছর ধরে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ছে। তবে গত দুই মাসে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে রোজা সংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম। টিসিবির তথ্যমতে, রাজধানীর খুচরা বাজারে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রতি কেজি চাল ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। অ্যাংকর ডাল ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ, ভোজ্যতেল সর্বোচ্চ ৪৩ দশমিক ৯২ শতাংশ, চিনি ২ দশমিক ২২ শতাংশ, প্রতি কেজি প্যাকেটজাত গুঁড়া দুধ ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি গত বছর একই সময়ের তুলনায় ৪৭ দশমিক ৬২ ও দেশি মুরগি ৮ দশমিক ২৮ শতাংশ, হলুদ ১৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ, গরুর মাংস শূন্য দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
আমদানিকারকরা জানান, ছোলার চাহিদা রোজায় বেশি থাকে। গত বছরের রোজার সময়ে করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির থাকায় ছোলার চাহিদা ছিল কম। যে কারণে ওই সময়ে আমদানি করা ছোলা এখনো রয়ে গেছে। আর এবারও বেশি আমদানি হয়েছে। তাই রোজার চাহিদার তুলনায় দেশে ছোলা বেশি রয়েছে। তবে দেখা যাচ্ছে, বাজারে ছোলার সরবরাহ ও মজুত পর্যাপ্ত থাকার পরও এর দাম বেড়েছে। দুই মাস আগে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা কেজি। এখন তা বেড়ে ৭৫-৮০ টাকায় উঠেছে। অথচ পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩০-৩৫ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে চিনি আমদানি হয়েছে ৩৮ কোটি ৫২ লাখ ৬০ হাজার ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৩৭ কোটি ১৪ লাখ ডলার। আলোচ্য সময়ে চিনি আমদানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ। তার পরও দুই মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি চিনি ৫ টাকা বেড়ে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ফল আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে ৩৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে ফল আমদানি হয়েছে ২৬ কোটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২১ কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার ডলার। ওই সময়ে আমদানি বেড়েছে ২২ দশমিক ১১ শতাংশ। তারপরও বাজারে ফলের দামে আগুন।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কারণে পণ্যের দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থির করে। বিশেষ করে প্রতিবছর রমজান আসলেই সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়ায়। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হলেও অসাধু ব্যবসায়ীরা কোনো ধরনের জবাবদিহির মধ্যে নেই। যে কারণে অসাধুরা নির্বিঘেœ কারসাজি করছে। এ ছাড়া বাজার তদারকি সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। একেক সংস্থা একেকভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে বাজার তদারকি করছে। তাদের মধ্যে সমন্বয় থাকা জরুরি।
এক জটিল উভয়সংকটের আকারে দিন দিন বেড়ে চলেছে করোনা মহামারির প্রকোপ। সংকটের একদিকে ভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তারের ঝুঁকি, অন্যদিকে সেই ঝুঁকি এড়ানোর লক্ষ্যে পুরো জাতির অবরুদ্ধ দশার অনিবার্য ফল হিসেবে উদ্ভূত জনদুর্ভোগ। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে আগুন। আর সেই আগুনে পুড়ছে সাধারণ মানুষ। উল্লেখ্য, একদিকে যেমন করোনার ভয় ও ঝুঁকি, অন্যদিকে পকেট উজাড়, ক্রেতা পড়েছেন মহাসংকটে। ফলে নাভিশ্বাস ওঠা ক্রেতা বাধ্য হয়ে বাড়তি দামেই বাজার সেরে ফিরছেন ঘরে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ক্রান্তিকালে মানুষ যখন চাকরি-বাকরি হারিয়ে কোনোরকমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে, ঠিক তখন চাল, তেল, সবজি, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। এতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের।