

রাউকের চেক জালিয়াতি, পৌনে ৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০১:০৯ এএম, ৭ এপ্রিল,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৩:১৩ পিএম, ২৭ সেপ্টেম্বর,
বুধবার,২০২৩

রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাউক) ৬৬৫টি চেক জালিয়াতি করে তিনটি ব্যাংক হিসাব থেকে ৭ কোটি ৬৩ লাখ ৫ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে সংস্থার সাবেক হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা এখলাছ উদ্দিনের বিরুদ্ধে। এসব চেক লেখার সময় উত্তোলন যোগ্য অর্থের আগে ও পরে ফাঁকা রাখা স্থানে ইচ্ছে মতো অঙ্ক বসিয়ে এই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। অডিট অধিদফতরের একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে জালিয়াতির এমন প্রমাণ উঠে এসেছে।
অডিট অধিদফতর এই অনিয়মের সঙ্গে সংস্থার কয়েকজন সাবেক চেয়ারম্যান, হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুললেও রাউক কর্তৃপক্ষ বলছে, এ ঘটনায় এখলাছ উদ্দিন ছাড়া আর কেউ জড়িত নন। যে কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যদিও অভিযুক্ত ওই কর্মকর্তার কাছ থেকে দুই কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আদালতে মামলাও হয়। এরইমধ্যে অভিযুক্ত এখলাছ উদ্দিন মারা যান। যে কারণে আত্মসাৎ করা বাকি টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে অভিযুক্তের ওয়ারিশদের পক্ষভুক্ত করে মামলা চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে রাউক কর্তৃপক্ষ। অডিট অধিদফতর বলছে, এই চেক জালিয়াতির ঘটনা শুধু একজন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের হিসাব শাখায় চেক জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক হিসাব থেকে ৭ কোটি ৬৩ লাখ ৫ হাজার টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ২০১০-২০১১ হতে ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরের হিসাব নিরীক্ষা করে এই অনিয়ম পাওয়া গেছে। অডিট অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ে নিরীক্ষা কার্যক্রমটি চলে ২০১৪ সালের ২ মার্চ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত। নিরীক্ষাকালে রাউকের হিসাব শাখার চেক রেজিস্টার, ব্যাংক থেকে টাকা তোলার স্টেটমেন্ট, চেক ও চেকের মুড়িসহ অন্যান্য বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা হয়। এতে দেখা যায়, রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের রাজশাহী শাখার হিসাব নং-২৪০১০৬১৪, যমুনা ব্যাংক লিমিটেডের রাজশাহী শাখার হিসাব নং-০০২৫০৩২০০০০১১০ এবং ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের রাজশাহী শাখার হিসাব নং-১৩৫-১২০-৮১০ থেকে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে অতিরিক্ত ৭ কোটি ৬৩ লাখ ৫ হাজার টাকা তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে। চেকে বিভিন্ন মেয়াদে স্বাক্ষরকারী রাউক চেয়ারম্যানরা হলেন, রাউকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান, মোসলে উদ্দিন, অপূর্ব কুমার বিশ্বাস, তপন চন্দ্র মজুমদার, আব্দুর রহিম ও মো. আবদুর রহিম। ওই মেয়াদের প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তারা হলেন আব্দুর রব জোয়ারদার, মসিহ-উল-আলম, আকতারুজ্জামান ও এস এম জাহেদুল ইসলাম। এর সঙ্গে তারাও জড়িত ছিলেন বলে অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অডিট অধিদফতর থেকে এই অনিয়মের বিষয়ে রাউকের কাছে জবাব চাওয়া হলে রাউক জানায়, এই জালিয়াতির তথ্য উদঘাটনের সঙ্গে সঙ্গে সংস্থার সাবেক ক্যাশিয়ার এখলাছ উদ্দিনের কাছ থেকে দুই কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। বিধি মোতাবেক তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে অডিটকে অবহিত করা হবে বলেও জবাবে জনানো হয়। কিন্তু এরপর আর কোনও জবাব পায়নি অডিট অধিদফতর। রাউকের এমন জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে অডিট অধিদফতর বলেছে, রাউকের জবাব স্বীকৃতিমূলক। কারণ, ইতোমধ্যে অভিযুক্ত ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে হতে দুই কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। অডিট অধিদফতর তাদের নিরীক্ষা মন্তব্যে বলেছে, ২০০৪-২০০৫ অর্থ বছর থেকে ২০১০-২০১১ অর্থ বছর পর্যন্ত ৬৬৫টি চেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ৭ কোটি ৬৩ লাখ ৫ হাজার টাকা ব্যাংক হতে অতিরিক্ত উত্তোলন করা হয়েছে, যা শুধুমাত্র ক্যাশিয়ারের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। চেকগুলোর অঙ্কে ও কথায় লেখার সময় বাম পাশে জায়গা ফাঁকা রেখে লেখা হয়েছে এবং পরবর্তীতে ফাঁকা জায়গায় অতিরিক্ত টাকার পরিমাণ অঙ্কে এবং কথায় সংযোজন করে এই জালিয়াতি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে চেকে স্বাক্ষরকারী কর্মকর্তারা চেকগুলোতে জায়গা রেখে তারপর স্বাক্ষর করেছেন। সুতরাং, চেকে স্বাক্ষরকারী কর্মকর্তারাও এই জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। অডিট অধিদফতর আরও বলেছে, অঙ্কে এবং কথায় টাকার পরিমাণ সংযোজনের ক্ষেত্রে লেখার ভিন্নতা স্পষ্ট এবং চেকগুলোর এক-একটিতে জালিয়াতির পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত।
কোনও কোনও ক্ষেত্রে একই দিনে ২টি চেকে ১০ লাখ টাকা করে ২০ লাখ টাকা তোলা হয়েছে। এত বিপুল পরিমাণ টাকার চেকে যেখানে অঙ্কে ও কথায় লেখার ভিন্নতা স্পষ্ট ছিল, সেখানে ব্যাংক ম্যানেজার টাকা পরিশোধের আগে চেকের স্বাক্ষরকারী কর্মকর্তার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেননি। এতেও প্রতীয়মান হয় যে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষও এই জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিষয়টি গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হিসেবে চিহ্নিত করে অডিট অধিদফতর থেকে ২০১৪ সালের ৩০ জুন অগ্রিম অনুচ্ছেদ হিসেবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠানো হয়। পরবর্তীতে একই বছরের ২৬ আগস্ট তাগিদপত্র ইস্যু করা হয়। সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে ওই বছরের ৩০ নভেম্বর আধা-সরকারি চিঠি দেওয়া হলেও কোনও সন্তোষজনক জবাব পায়নি অডিট অধিদফতর। এ অবস্থায় চেক জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক হতে অতিরিক্ত উত্তোলিত টাকা দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের কাছ থেকে আদায় ও তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে অডিট অধিদফতরকে অবহিত করার জন্য নিরীক্ষার সুপারিশ করা হয়। জানা গেছে, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আত্মসাৎ করা টাকা উদ্ধারের জন্য রাজশাহী জেলা যুগ্ম জজ আদালত-১ এ ২০১৩ সালে বিবাদী এখলাছ উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। এখলাছ উদ্দিন ২০১৫ সালের ৩০ আগস্ট মারা যান। পরে তার ওয়ারিশদের এই মামলায় পক্ষভুক্ত করা হয়। অবশ্য মামলার কারণে তার ব্যাংক হিসাব স্থগিত রয়েছে। সেই সঙ্গে এখলাছ উদ্দিনের সম্পত্তি নষ্ট কিংবা বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এখলাছ উদ্দিন জীবিত থাকাবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা নিলে সরকারের আত্মসাৎ করা অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হতো। সে সময় কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেই এই টাকা উদ্ধার করা হয়নি। বিষয়টি সম্পর্কে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. আনওয়ার হোসেন বলেন, ‘আত্মসাৎ করা ৭ কোটি ৬৩ লাখ ৫ হাজার টাকার মধ্যে ২ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছেন সাবেক ক্যাশিয়ার এখলাছ উদ্দিন। বাকি টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য ৩০০ টাকার নন জুডিসিয়াল স্টাম্পে অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি। কিন্তু টাকা ফেরত না দেওয়ায় রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতে মানিলন্ডারিং আইনে দুদক বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। ২০১৭ সালে আদালত তার সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত ও তার ওয়ারিশদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। এজন্য চলতি বছরের ২ মার্চ দুটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। ব্যাংক হিসাব ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কেন চেকের মধ্যে ফাঁকা জায়গা রেখে টাকার পরিমাণ লেখা হতো সে বিষয়ে কিছু জানা গেছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে আনওয়ার হোসেন বলেন, ‘এ ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এখলাছ উদ্দিন একাই জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বিষয়টি তিনি নিজেও স্বীকার করে ২ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছেন। তিনি এ ঘটনার দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছেন। যেখানে তিনি নিজে আত্মসাৎ করা মোট টাকার ব্যাপারে নিজে অঙ্গীকার করেছেন, সেখানে আমার মতে অন্য কেউ জড়িত নেই।
তিনি আরও বলেন, ‘এখলাছ উদ্দিন চেক লেখার সময় কৌশল অবলম্বন করে টাকাগুলো আত্মসাৎ করেছেন। স্বাক্ষরের পর চেকের ডান ও বাম দিকে সামান্য ফাঁকা রেখে কৌশল অবলম্বন করে সংখ্যা ও অক্ষর বসিয়ে বিভিন্ন সময় জালিয়াতির মাধ্যমে ছোট অঙ্কের চেক বড় অঙ্ক করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এরপর বিষয়টি ধরা পড়লে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তিনি জেল খাটেন। পরে জামিন নেওয়ার পর তিনি মারা যান। তবে বর্তমানে প্রযুক্তির কারণে তার মতো করে চেক জালিয়াতি করার কোনও সুযোগ নেই।