হাসপাতালে ঠাঁই নেই করোনা রোগীদের
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২:০১ এএম, ২ এপ্রিল,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ১২:০৮ এএম, ৩ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
ঢাকার মোহাম্মদপুরের আলী মোর্শেদ নোটনের স্ত্রীর করোনাভাইরাস ধরা পড়লে গত ২৪ মার্চ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু চারদিন পর চিকিৎসক যখন তাকে আইসিইউতে নিতে বললেন, আর নোটন যখন জানলেন যে ঢাকা মেডিকেলের কোভিড ইউনিটে আইসিইউ শয্যা খালি নেই, তখন তার পানিতে পড়ার দশা। তিনি বলেন, “সরকারি-বেসরকারি সবকটি কোভিড হাসপাতালে যোগাযোগ করেছি আমি, কোথাও ফাঁকা পাচ্ছিলেন না। সারা রাত ধরে কমপক্ষে ৫০টা জায়গায় ফোন করেছি। কোথাও আইসিইউ নাই।” পরে গ্রিনরোডের এক হাসপাতালে একটি আইসিইউ শয্যা পেয়ে স্ত্রীকে দ্রুত সেখানে ভর্তি করান নোটন। এখনও তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন। নোটনের মতো এমন সঙ্কটে পড়া মানুষের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলো। বেসরকারি হাসপাতালেও শয্যা পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। এক মাস আগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে হাসপাতালগুলোর ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ শয্যায় রোগী ভর্তি ছিল। বুধবার তা বেড়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি যেখানে আইসিইউর ২৫ দশমিক ২৬ শতাংশ শয্যা পূর্ণ ছিল, ৩১ মার্চ তা বেড়ে হয়েছে ৬৫ শতাংশ। এ অবস্থায় হাসপাতালে সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার দ্রুত জোরালো পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসে প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সম্প্রসারণ করে মহামারী নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিল সরকার। পরে রোগী কমে আসায় সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে কয়েকটি হাসপাতালে কোভিড চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরই মধ্যে ডিসেম্বরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের নি¤œমুখী প্রবণতা শুরু হয় দেশে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে দৈনিক শনাক্তের হার নেমে আসে তিন শতাংশের নিচে। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে সংক্রমণ আবার বাড়ছে দ্রুত গতিতে। গত এক দিনে রেকর্ড ৫ হাজার ৩৫৮ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ৫২ জনের।
বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঢাকা মহানগরীর সরকারি ১০টি কোভিড হাসপাতালের ২ হাজার ৫১১টি সাধারণ শয্যার মধ্যে খালি রয়েছে ২৬৫টি। আর ১০৮টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে খালি আছে মাত্র ৫টি। এর মধ্যে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই।
হাসপাতালে হাহাকার : এরই মধ্যে অবস্থা কতটা নাজুক হয়ে উঠেছে, তা স্পষ্ট হল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল নাজমুল হকের কথায়। “বিশাল চাপ এখন করোনা রোগীদের। কোনো বেড আমাদের ফাঁকা নেই। জেনারেল যারা মেডিসিনের কেইস নিয়ে আসছেন, তাদের নিতে পারছি না আমরা। “আমাদের কোভিড সার্জারি ও গাইনির কিছু বেড ফাঁকা আছে। কোভিড মেডিসিনের কোনো বেড খালি নেই। ক্ষমতার চেয়েও বেশি রোগী নিয়ে আছি আমরা।” আগের তুলনায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি ‘ক্রিটিক্যাল’ রোগী এখন চিকিৎসার জন্য আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বয়স্করা হয়ত বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিল। কিন্তু অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাওয়ায় তারাও ক্রিটিক্যাল রোগী হিসেবে আসছেন। “এভাবে যদি চলতে থাকে, আমরা যদি লাগাম টেনে ধরতে না পারি, এটা কিন্তু দুই-তিন সপ্তাহ পরে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। মানুষের দুর্দশাও বাড়বে। একটা কঠিন সময় আসছে আমাদের জন্য।” বিষয়টি ব্যাখ্যা করে নাজমুল হক বলেন, দৈনিক ৫ হাজার রোগী শনাক্ত হলে তার মধ্যে ১ শতাংশ রোগীর অবস্থা গুরুতর হবে, তাদের জন্য আইসিইউ বা এইচডিইউ সুবিধা লাগবে- এটা আন্তর্জাতিকভাবে ধরে নেওয়া হয়। “আজ যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, ১০দিন পর তাদের মধ্য থেকে ক্রিটিক্যাল রোগী আসতে থাকবে। তখন আমরা কোথায় জায়গা দেব? এই অবস্থা আমরাও এক মাস আগেও জানতাম না।” পরিচালক বলেন, “আমরা ঢাকা মেডিকেলের ফ্লোরে আনাচে-কানাচে রোগী রাখতে পারি, এমন একটা বিষয় মনে করে সবাই। কিন্তু আসলে কোভিডে সেটা সম্ভব না, কেননা কোভিডে অক্সিজেন লাগে। সবার অক্সিজেন লাইন লাগে। যে কয়টা অক্সিজেন লাইন আছে, সবগুলোতেই আমরা রোগীদের সেবা দিচ্ছি। কোনটাই কিন্তু খালি নেই।”
সে কারণে অনেক রোগী এলেও তাদের চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের এখানে সর্বোচ্চ সংখ্যক অক্সিজেন সাপোর্ট সেন্টার করা হয়েছে। প্রতিটি জায়গায় আমাদের লোক আছে। কাউকেই তো আমরা বাদ দিতে পারছি না। ৭০০ অক্সিজেন সাপোর্টের ব্যবস্থা আছে আমাদের এখানে। “কিন্তু এখন এত রোগী আসছে, এত রোগীর ব্যবস্থাপনা করাও সহজ না। ডাক্তার, নার্সরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করছে, লোড বেড়ে গেছে অনেক। কিন্তু অক্সিজেনের কারণে রোগী ফেরত যাচ্ছে।” হাসপাতালের চাপ কমাতে অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল ৯২ এর নিচে নেমে গেলে তখন কোভিড রোগীদের হাসপাতালে আনার কথা বললেন পরিচালক। পরিস্থিতি যে দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক খলিলুর রহমানও সে কথা বললেন। “রোগীর খুবই চাপ, আমরা ঠাঁই দিতে পারছি না এমন একটা অবস্থা। বেডগুলো আজকে মোটামুটি পূর্ণ। দুই-একদিনের মধ্যে ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট চালু হবে আমাদের এখানে। এখন সাধারণ বেড আছে ১৫০টা। আরও ৫০টা বেড আমরা শনিবারের মধ্যে চালু করব।” নতুন রোগীদের অধিকাংশেরই অক্সিজেনের প্রয়োজন হচ্ছে জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, “অক্সিজেনের রোগী ছাড়া আমরা ভর্তি নিচ্ছি না।” কোভিড রোগী এভাবে বাড়তে থাকলে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নন-কোভিড রোগের চিকিৎসা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে কোভিডের চিকিৎসা চালানো হবে বলে জানালেন খলিলুর রহমান। মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাথ গণমাধ্যমকে বলেন, “আমাদের ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীর অবস্থা খারাপ হলে আইসিইউতে স্থানান্তর করি। অবস্থা ভালো হলে আবার ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। খালি থাকলে বাইরে থেকে রোগী ভর্তি করা হয়। তবে এখন প্রতিদিনই আইসিইউ বেডের জন্য রিকোয়েস্ট আসছে। আর সাধারণ ওয়ার্ডের কথা যদি বলি, ওয়ার্ডগুলোতে কিছু শয্যা খালি আছে, তবে রোগী ভর্তির পরিমাণ আগের থেকে চারগুণ বেড়েছে।” রোগীর চাপ বেড়েছে বেসরকারি হাসপাতালেও। এভারকেয়ার হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক ডা. আরিফ মাহমুদ জানালেন, কয়েক সপ্তাহ আগে হাসপাতালের কোভিড ইউনিট প্রায় ফাঁকা ছিল। ১৯ মার্চের পর থেকে রোগীর চাপ আবার বেড়ে গেছে। “২৮টা কেবিন, ১২টা আইসিইউর একটাও ফাঁকা নেই। অনেক রোগীর স্বজনরা সিটের জন্য অনুরোধ করলেও ভর্তি নেওয়া যাচ্ছে না। এক সময় আমরা চিন্তা করছিলাম বেড কমিয়ে ফেলব কি না। কিন্তু অনেক রোগীকে ফেরত দিতে হচ্ছে, অনেকেই সরাসরি চলে আসছেন, তারা ফেরত যাচ্ছে।” ডা. আরিফ জানালেন, এখন যারা কোভিড নিয়ে হাসপাতালে আসছেন, তাদের মধ্যে তরুণরা বেশি। হাসপাতালে রোগীর চাপ ক্রমাগত বাড়ছে জানিয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালের কমিউনিটেকশন অ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্টের প্রধান ডা. সেগুফা আনোয়ার বলেন, “কোনো সিট নাই। আপনি যদি সিট চান, আমি দিতে পারব না। আমি এখন কারও ফোন ধরতে ভয় পাই। কারণ ‘না’ বলতে হবে। খুব কষ্টের ব্যাপার। “আইসিইউ থেকে কেবিনে নেব, কেবিন খালি পাই না। কেবিনের রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে, আইসিইউ নাই; এই হল অবস্থা।”
সঙ্কটের সংখ্যাচিত্র : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার সারাদেশে ৯ হাজার ৯১১টি সাধারণ শয্যার ৩ হাজার ৯৭২টি এবং ৫৭৮টি আইসিইউ শয্যার ৩৭৬টিতে রোগী ভর্তি আছে। রাজধানীতে রোগীর চাপ আরও বেশি। ঢাকার কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর ৩ হাজার ৪৩৯টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ২ হাজার ৭৯৩টিতে রোগী ভর্তি আছে। অর্থাৎ ৮১ শতাংশ শয্যা এখন ভর্তি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালোর ৮৯ শতাংশ এবং বেসরকারি হাসপাতালের ৫৯ শতাংশ শয্যায় এখন রোগী আছে। অথচ ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সরকারি হাসপাতালের ৩১ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং বেসরকারি হাসপাতালে ৩৫ দশমিক ০২ শতাংশ শয্যায় রোগী ভর্তি ছিল। বুধবার ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোর ১০৮টি আইসিইউ শয্যার ১০৩টি এবং বেসরকারিতে ১৮৮টি আইসিইউ শয্যার ১৪৩টিতে রোগী ভর্তি আছে। অর্থাৎ সরকারি হাসপাতালের ৯৫ শতাংশ এবং বেসরকারি হাসপাতালের ৭৬ শতাংশ আইসিইউ শয্যায় এখন রোগী আছে। আর ২৮ ফেব্রুয়ারি সরকারি হাসপাতালের ৩৭ শতাংশ, বেসরকারি হাসপাতালের ১২ শতাংশ সাধারণ শয্যা এবং সরকারিতে ৬৫ শতাংশ ও বেসরকারিতে ১৬ শতাংশ আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি ছিল।