ইকবাল হোসেন শ্যামল
রাজনীতিকে আওয়ামীকরণ
প্রকাশ: ০২:২২ এএম, ৭ জুলাই, বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৪৯ এএম, ১০ অক্টোবর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পক্ষে মীর মদন, মোহনলাল বীরদর্পে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু নবাবের প্রধান সেনাপতি মীরজাফর স্থির দাঁড়িয়ে ছিলেন তার অনুগত সৈন্যবাহিনী নিয়ে। কারণ তিনি ইংরেজদের দয়ায় বাংলার মসনদে বসার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। জগৎশেঠসহ কতিপয় আমাত্য রাজ খাজানা ও লুটপাটের আশায় এবং বিনা শুল্কে ব্যবসা করার জন্য মীরজাফরকে অনুসরণ করেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না মীরজাফরের মত বিশ্বাসঘাতকদের। তিনি ইতিহাসে কলঙ্ক হয়ে আছেন। যুদ্ধে পরাজয়ের পর নবাব জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যান। কিন্তু ধরা পড়েন। তাকে নেয়া হয় মুর্শিদাবাদে। তাকে এক নজর দেখার জন্য রাস্তার দু’পাশে জনতার ভিড় জমে। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য! লর্ড ক্লাইভের আত্মজীবনীতে পাওয়া যায় যে, তখন যদি জনতা ইংরেজ বাহিনীর উপর একটি করে নুড়ি পাথর নিক্ষেপ করত তাহলে ইংরেজ বাহিনীর উপর এভারেস্টসম পর্বত সৃষ্টি হতো এবং এই পাথরে চাপা পড়ে ইংরেজ বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। কিন্তু সেই অবস্থা তখন ছিল না। কারণ চারদিকে ছিল ঘষেটি বেগম-জগৎ শেঠরা। ১৯৫৫ সাল আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট জুয়ান পেরোন দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন এবং ১৮ বছর পর ১৯৭৩ সালে সেখান থেকে দেশে ফিরেন। ৩০ লক্ষ মানুষ এয়ারপোর্টে তাকে স্বাগত জানান। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা যদি পালিয়ে যেতে পারতেন তাহলে তিনি প্রজাদের সংগঠিত করে আবার ক্ষমতায় আসতে পারতেন। দুইশ বছর ইংরেজরা বাংলা শাসন করতে পারত না।
১৯৬৪ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনি নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন এবং ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসেন। ফ্রান্স থেকে খোমেনী যখন ইরানে ফিরলেন তখন ৬০ লক্ষ মানুষ তাকে এয়ারপোর্টে স্বাগত জানান। ইরানী জনগণকে বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করতে, রেজা শাহ পাহলভীর দুর্নীতি প্রকাশ করতে এবং আধুনিক ইরান বিনির্মাণে তার লালিত স্বপ্নগুলো তিনি ছোট পুস্তিকা এবং টেপ রেকর্ডারে ক্যাসেটের মাধ্যমে ইরানী জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ২০১১ সালে ‘আরব-বসন্ত’-এর মাধ্যমে তিউনিসিয়ার বেন আলীর পতন ঘটিয়ে দেশে ফিরে আসেন রশিদ আল ঘানুচি। তিনি আন্নাহদাহ পার্টির নেতা এবং দীর্ঘ দুই দশক লন্ডনে নির্বাসিত ছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কিংবা ধর্মীয় মতাদর্শের কারণে কিংবা ব্যক্তিগত বিশ্বাসের কারণে বহু রাজনৈতিক নেতা, ধর্মপ্রচারক, কবি, দার্শনিকদের মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে নির্বাসনে যেতে হয়েছে। পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লামকে ‘আল্লাহর একাত্মবাদ’ প্রচার করার কারণে মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করতে হয়েছিল। মহাত্মা করমচাঁদ গান্ধীকেও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কারণে আফ্রিকায় নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’ নির্বাসিত অবস্থায় রচনা করেন ইতালির বিখ্যাত কবি দান্তে।
রাজনৈতিক পটভূমির কারণে কখনও কখনও শুধু নেতা নয়, বরং পুরো সরকারকেই নির্বাসনে যেতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারকেও প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
কিন্তু সিরাজদ্দৌলার আমলটা এমন ছিল না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজ জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধিত হয়ে পুরো বিশ্ব একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আজ আমরা মুহূর্তের মধ্যেই সংযোগ স্থাপন করতে পারি পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে। কিন্তু তারপরও আজ এই গ্লোবাল ভিলেজ থেকে অগণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে কোন ডাক আসে না।
২০০৭ সালের ২১ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাতিল করে ক্ষমতা দখল করে মইন আহমদ গং। আধিপত্যবাদী শক্তির পদলেহনকারীরা গ্রেফতার করে বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দলের প্রধান দুই নেত্রীকে। গ্রেফতার করে তৎকালীন সময়ের তুমুল জনপ্রিয় নেতা মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান (বীরউত্তম) এবং তিনবারের প্রধানমন্ত্রী আপোসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানকে। করা হয় অমানুষিক নির্যাতন। বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চরিত্র হননের মহাকর্মযজ্ঞ চালায় ১/১১ সরকার। সংস্কারের নামে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিকে ভাঙ্গার চেষ্টা করা হয়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে চলে যান। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে যখন বিদেশে চলে যেতে বলা হয় তখন তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন- “বাংলাদেশ ছাড়া আমার কোন ঠিকানা নেই। বাঁচি-মরি আমি এদেশেই থাকবো।” পরবর্তী সময়ে আগস্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ছাত্র আন্দোলন ১/১১ সরকারের বিদায়ের পথ প্রশস্ত করে। রিমান্ডের নামে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অসুস্থ তারেক রহমান সুচিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান। গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে বিশৃঙ্খল একটি পরিবেশে অপ্রস্তুুত অবস্থায় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নেন। যদিও ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল একটি পাতানো ছকের। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আনা হয় আওয়ামী লীগকে। গণতন্ত্রের মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হয়ে গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে সরকারকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাকশালী প্রেতাত্মারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। উদ্দেশ্য ছিল ’৭৩ সালের মত নির্বাচন করে তারা আজীবন ক্ষমতায় থেকে যাবে। পরিকলাপনা অনুযায়ী কাজ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন করা হয়। ১৫৪ আসন বিনা ভোটে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা নির্বাচিত হয়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন করা হয় ২৯ ডিসেম্বর রাতে। আগামী নির্বাচন করবে ইভিএমে। এরপরে নির্বাচন করবে আরেক পদ্ধতিতে। তার মানে আওয়ামীরা কখনোই ক্ষমতা ছাড়বে না। এদিকে রাজনীতির কোমড়ে পুলিশের দড়ি, আর গণতন্ত্রকে মাস্ক পরানো হয়েছে। আমাদের অবস্থা সিরাজদ্দৌলার অবস্থার চেয়েও খারাপ। আধিপত্যবাদী শক্তির সাথে যোগসাজশ করে আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ১/১১ সরকার রাজনীতিকে আওয়ামীকরণ করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেও রাজনীতিকে আওয়ামীকরণের ধারা অব্যাহত রাখে। তার মানে আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশে এখন ভিন্নমতের কোন রাজনীতি নেই। দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। যেখানে দিনের ভোট রাতে হয়, জনগণ যেখানে নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল নয়, সেখানে জনপ্রতিনিধিদের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে না। নেতৃত্ব হয়ে পড়ে তোষামোদকারীতে। আমলাতন্ত্র ক্ষমতাশালী হয়, রাষ্ট্র হয়ে পড়ে অকার্যকর ।
বিরোধী দলকে দমন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ আজ রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার দ্বারপ্রান্তে। সংসদে তোফায়েল আহমেদ, শেখ সেলিম, কাজী ফিরোজ রশীদরা অসহায়ত্ব প্রকাশ করে সচিব, ডিসি এবং এসপিদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করে। প্রায়শই সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধিদের পুলিশি হয়রানির সংবাদ দেখি। আমলাতন্ত্রের অনুকম্পায় যারা জনপ্রতিনিধি তারা প্রকৃত অর্থে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন না। আর তাই আগে যেখানে বিভিন্ন জেলার উন্নয়ন কার্যক্রম তদারকি করার দায়িত্ব পেত মন্ত্রীরা, এখন সেখানে সচিবরা দায়িত্ব পালন করছেন। আগুনে পুড়ে যেমন লোহা ইস্পাতে পরিণত হয়, ঠিক তেমনি জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে জাতীয়তাবাদী নেতাকর্মীদের ভেতর গড়ে উঠেছে ইস্পাত কঠিন ঐক্য এবং শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো। ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সারা বাংলাদেশে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ মতামতের ভিত্তিতে দেশনায়ক তারেক রহমানকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাংগঠনিক অভিভাবক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। তারেক রহমানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে সংগঠনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে শুরু হয় তৃণমূলে সাংগঠনিক কাঠামো পুনঃগঠন প্রক্রিয়া, যা অদ্যাবধি চলমান। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা জিয়াউর রহমানের আদর্শকে ধারণ করে ছাত্রদলের প্রত্যেকটি নেতাকর্মী তাদের ধমনীর প্রতিটি রক্ত কণিকায়। তারেক রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রদলের হাত ধরেই ইনশাল্লাহ গণতন্ত্রের বিজয় কেতন উড়বে।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল