গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করতে পুলিশ হাতিয়ার
প্রকাশ: ০২:০৭ এএম, ৭ এপ্রিল, বুধবার,২০২১ | আপডেট: ১২:৪২ এএম, ৯ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনা সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে আগমনের প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামিক দলগুলো প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে, তবে হেফাজতের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। মোদি বাংলাদেশে আসার প্রতিবাদের কারণ হিসেবে প্রতিবাদকারীরা ঘোষণা করেছে যে, ১. মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাবস্থায় অনেক মুসলমানকে হত্যা করেছে যার জন্য তিনি গুজরাটের কসাই হিসাবেও পরিচিত, ২. সম্প্রতি টি.আর.সি বিধি বিধান করার মাধ্যমে মোদি সরকার ভারত থেকে মুসলমানদের বিতারিত করার উদ্যোগ নিয়েছে এবং এর প্রতিবাদ করায় অকাতরে ভারতে মুসলমান নিধন হয়েছে, ৩. পবিত্র কোরান শরীফের ২৬টি আয়াত সংশোধন করার জন্য ভারতের একটি হাইকোর্টে রীট হয়েছে যার আশ্রয়/প্রশ্রয়দাতা ভারত সরকার। সর্বোপরি মোদির উস্কানিতে ভারতে মুসলমানরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। মোদি এবং মোদির দল একটি সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত। মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন ভারত সরকার ও গান্ধী পরিবারের যে সহযোগিতা ছিল, অনুরূপ ভূমিকা বিজেপী পন্থীদের ছিল না। বাংলাদেশের জনগণ গান্ধী পরিবারের বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধীর সে সময়ের ভূমিকাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। কোন দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান যদি বাংলাদেশে আগমন করে তবে তা গৌরবের বিষয় বটে, কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ আছে তাদেরকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের আপামর জনগণ সাদর সম্ভাষণ জানাবে কোন কারণে? বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু, তবে অসাম্প্রদায়িক, মোট জনসংখ্যার ৯২% মানুষ মুসলমান এবং ইসলাম একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্ম। ধর্মীয় বিবেচনায় কারো ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করা বা ধর্মকে নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার দৃষ্টান্ত হযরত মোহাম্মদ (সা:) জীবনীতে দেখা যায় নাই। বরং সংখ্যালঘু জনগণ সংখ্যাগুরুদের আমানত হিসেবে তিনি ঘোষণা করেছেন। বিদায় হজের ভাষণে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করারও নির্দেশনা রয়েছে। তবে ধর্মের উপর যদি কোন আঘাত আসে বা শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার কারণে যদি বিনা বিচারে হত্যা করা হয় সেখানে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদতো করতেই হবে এবং এটাই ধর্মীয় বিধান।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)-এর প্রতি কটাক্ষ করায় গোটা বিশ্ব প্রতিবাদ করেছে, ফলশ্রুতিতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং গোটা বিশ্ব তার প্রতি ঘৃণায় থুথু নিক্ষেপ করেছে। হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামী দলগুলো এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমান মাত্রই মোদির ঢাকায় আগমনের প্রতিবাদ করেছে, যারা ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষুর ভয়ে বা সরকারি চাকরি হারানোর ভয়ে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে পারে নাই তারাও ঘৃণা পোষণ করেছে, তবে মুসলমান নামধারী যারা নাস্তিক তাদের কথা আলাদা। বহু রক্তের বিনিময়ে সম্পাাদত বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান মোতাবেক নাগরিকদের চিন্তা-চেতনার ও প্রতিবাদ করার অধিকার দিয়েছে। দেখা মতে, মোদির আগমনকে ইসলামী চিন্তাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই প্রতিবাদ জানিয়েছে। গোটা বিশ্বে এ ধরনের অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে, পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রেও সরকারের দাওয়াতী মেহমানকে ‘ফিরে যাও’ পোস্টার, প্লেকার্ড, ব্যানার বিমানবন্দরে বা রেল স্টেশনে প্রতিবাদকারীরা প্রদর্শন করেছে। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিধায় মোদির বাংলাদেশে আগমনের নিয়মতান্ত্রিক বিরোধিতা বা প্রতিবাদ করার সাংবিধানিক অধিকার একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকের রয়েছে, নতুবা বুঝা যাবে যে সে দেশের নাগরিক কাগজে-কলমে স্বাধীন হলেও মন-মানসিকতার প্রশ্নে বিবেকের স্বাধীনতা এখনো অর্জিত হয় নাই।
মোদি বিরোধী অবস্থানের কারণে মুসল্লি-পুলিশ সংঘর্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৯ জন হত্যা হয়েছে বলে হেফাজতে ইসলাম দাবি করেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, “ঢাকায় বায়তুল মোকাররমের মুসল্লিদের সাথে পুলিশ ও যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ জনকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে, আটক করা হয়েছে শতাধিক মুসল্লীকে।” এ মর্মে পুলিশের সাথে অস্ত্র উঁচিয়ে সাদা পোশাকে একটি সশস্ত্র বাহিনীর একটি সচিত্র প্রতিবেদন জাতীয় দৈনিকে ২৭শে মার্চ প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকার সচিত্র ভাষ্যমতে পুলিশের সাথের অস্ত্রধারীরা আওয়ামী ছাত্রলীগ-যুবলীগ। হেফাজতকে মোকাবেলার জন্য রাষ্ট্র বা সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সরকারি দলের ক্যাডারদের লেলিয়ে দেয়া একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কতটুকু যৌক্তিক? অন্যদিকে মোদির আগমনের বিরোধিতা করে প্রতিবাদকারীদের প্রতিবাদ কর্মসূচি করার সশস্ত্র বাধা প্রদান না করলে সরকার কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হতো? ১৯ জনের (হেফাজত ও পত্রিকার ভাষ্যমতে) জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশে মোদির আগমনে শেখ হাসিনা সরকারের কতটুকু লাভ-ক্ষতি হয়েছে, তা ‘সময়ই’ বলে দিবে।
মোদিকে আমন্ত্রণ করে বাংলাদেশ সফরে এনে লাভবান হচ্ছে কি বাংলাদেশ, নাকি এটা হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক ফয়দা? নাকি মোদিরও রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে? তিস্তার পানি বাংলাদেশের জন্য একটি বার্নিং ইস্যু। ইতোপূর্বেও শেখ হাসিনা সরকারের আমন্ত্রণে মোদি বাংলাদেশ সফর করেছেন। তখনো প্রত্যাশা করা হয়েছিল যে, মোদি সরকারের সময়কালের মধ্যেই তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হবে। মোদি পুনরায় নির্বাচিত হলেও চুক্তি স্বাক্ষর হয় নাই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেও কয়েক দফা ভারত সফরে গিয়েছেন, প্রতিবারই তিস্তার পানি ছাড়াই তিনি ফেরত এসেছেন। এবারও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মোদি বলেছেনÑ ‘তিস্তার পানি দেয়ার জন্য আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ’ , কিন্তু কবে, কখন তিস্তার পানি বাংলাদেশ পাবে, এ সম্পর্কে মোদি কোন প্রতিশ্রুতি প্রদান করে নাই। অন্যদিকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী প্রকাশ্যে বলে দিয়েছে যে, “তিস্তার পানি দেওয়া সম্ভব নহে”। অথচ এ দোটানার মধ্যেই ভারতের স্বার্থ জড়িত চুক্তিগুলো সম্পাদিত হলেও বাংলাদেশের স্বার্থ সম্বলিত কোন চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে কিনা তা আদৌ জনগণ জানে না। অন্যদিকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী দাবি করেছেন যে, মোদি তার দলীয় রাজনীতির ফায়দা হাসিলের জন্য বাংলাদেশে গিয়েছেন। মমতার মতেÑ বাংলাদেশে গোপালগঞ্জে বসবাসকারী মাতুয়া সম্প্রদায়ের একটি বিরাট অংশ ভারতের নাগরিক বিধায় ভারতীয় মাতুয়াদের সমর্থন লাভের জন্য বাংলাদেশে মোদির আগমনের কারণের জন্য মমতা মোদির ভিসা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। বাংলাদেশে আগমনে মোদি কতটুকু লাভবান তা আলোচনার মুখ্য বিষয় নহে, মুখ্য বিষয়টি হচ্ছে এ সফরে বাংলাদেশের আপামর জনগণ কতটুকু সন্তুষ্ট? পত্রিকান্তরে প্রকাশ, বিভিন্ন জেলায় গাড়ি পোড়ানোসহ সহিংসতার জন্য অনেক মামলা হয়েছে। ঢাকার পার্শ¦বর্তী সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ৬টি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে বিএনপি নেতাকর্মীদেরই সংখ্যাই বেশি। এর মধ্যে ৫/৬ বছরের পূর্বে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে মৃত্যুবরণকারী সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির আহ্বায়ক আলী হোসেনের নামও আসামি হিসেবে রয়েছে। অন্যান্য জেলায়ও অনুরূপভাবে বিএনপির নেতা-কর্মীরাই আসামি। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, বিএনপিকে মাঠছাড়া করার উদ্দেশ্যেই এ ধরনের মামলা, যা সরকারের সাজানো নাটকও বলা হচ্ছে। ফলে ২৭/০৩/২০২১ ইং তারিখে জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অর্থাৎ পুলিশের সাথে যে সকল অস্ত্রধারী রয়েছে পত্রিকার ভাষ্যমতে তারা আওয়ামী লীগের অংগসংগঠন ছাত্রলীগ-যুবলীগ।
বিরোধী মতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধ করার জন্য যে স্টীম রোলার সরকার চালাচ্ছে তার হাতিয়ার হিসেবে নগ্নভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে পুলিশ, প্রশাসন, আইন ও আদালত। পুলিশ, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এখন জনগণের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, যার ফায়দা পুলিশও নিচ্ছে। সরকার অনৈতিকভাবে পুলিশকে ব্যবহার করছে বিধায় পুলিশের একটি অংশ নিজেরাও অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছে। পত্রিকা খুললেই দেখা যায় মাদক, চাঁদাবাজি ও অপহরণমূলক অভিযোগে পুলিশ সদস্য গ্রেফতার হচ্ছে। অথচ তাদের প্রমোশন হচ্চে যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পুলিশ সরকার বিরোধীদের নির্মূল করার জন্য মিথ্যা মামলা সৃজন, গ্রেফতার, রিমান্ড ও চার্জশীট দেয়ার জন্য পেশাগত যুগান্তকারী কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়েছে। পাকিস্তান আমলে ভোটে পুকুর চুরি হয়েছে, কিন্তু বর্তমান সরকার আমলে হচ্ছে ভোটারবিহীন ভোট, অর্থাৎ নির্বাচনে সমুদ্র চুরি। পুলিশ বাহিনীর বড় বড় কর্মকর্তারা পুলিশের পেশাদারীত্ব ও পেশার মান বৃদ্ধি করার জন্য প্রায়শই বাহিনীর নি¤œস্থ সদস্যদের নির্দেশাবলী জারি করাসহ বক্তৃতা করে থাকেন যা ফলাও করে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, কোথাও জনগণ বাহাবা দেয়, কোথাওবা কথা ও কাজের সমন্বয় কোথায়, তা খোঁজার চেষ্টা করে। আইনগতভাবে পুলিশের পেশাগত দায়িত্ব হচ্ছে অবৈধ অস্ত্রধারী ও অস্ত্র ব্যবহারকারীদের গ্রেফতার করা, কিন্তু হেফাজতের ঘটনায় ঘটেছে বিপরীত ধর্মীয় ঘটনা এবং সরকার বিরোধীদের ঠেঙ্গানোর জন্য হরহামেশা পুলিশ এ ধরনের ভূমিকাই গ্রহণ করে থাকে। কার্যত পুলিশ এখন আইনের ঊর্ধ্বে। ২০১৩ সালে পুলিশ কাস্টডিতে নির্যাতন বন্ধ করার জন্য আইন পাস হয়েছে, কিন্তু সে আইন সম্পূর্ণভাবে এখনো অকার্যকর। পুলিশকে জনগণের জানমাল রক্ষার জন্য পেশাদারি করার জন্য সরকার দাবি করে এবং এজন্যই নৈতিকতার প্রশ্নে প্রশ্ন জাগেÑ বাইতুল মোর্কারমে অস্ত্র হাতে পুলিশের সাথে এরা কারা?
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
taimuralamkhandaker@gmail.com
----------------------------------------------------------------------------------------------------------
মোদি বিরোধী অবস্থানের কারণে মুসল্লি-পুলিশ সংঘর্ষে দেশের বিভিন্নস্থানে ১৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে হেফাজতে ইসলাম দাবি করেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ‘ঢাকায় বায়তুল মোকাররমের মুসল্লিদের সাথে পুলিশ ও যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষে শতাধিক আহত হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ জনকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে, আটক করা হয়েছে শতাধিক মুসল্লীকে।’ এ মর্মে পুলিশের সাথে অস্ত্র উঁচিয়ে সাদা পোশাকে সশস্ত্র বাহিনীর একটি সচিত্র প্রতিবেদন জাতীয় দৈনিকে ২৭ মার্চ প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকার সচিত্র ভাষ্যমতে পুলিশের সাথের অস্ত্রধারীরা আওয়ামী ছাত্রলীগ-যুবলীগ। হেফাজতকে মোকাবেলার জন্য রাষ্ট্র বা সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সরকারি দলের ক্যাডারদের লেলিয়ে দেয়া একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কতটুকু যৌক্তিক