ড্যাপের ১৫ প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৩৬ এএম, ১২ জানুয়ারী,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৩৯ এএম, ৭ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে সরকারের নেয়া বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) বাস্তবায়নে শঙ্কা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ না করায় এই শঙ্কা দেখছেন তারা। অনেকেই ড্যাপের প্রকল্প নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। এ বিষয়ে তাদের অভিমত, ড্যাপ বাস্তবায়নে নেয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন খুবই জটিল এবং সময় সাপেক্ষ। তাই ড্যাপ বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা থাকাটাই স্বাভাবিক। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
অপরদিকে সরকার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রাজধানীতে নাগরিকদের শুধু স্লিপিং স্পেস (ঘুমানোর জায়গা) নয়, তাদের জন্য একটা স্বাস্থ্যকর, নাগরিক সুবিধাসম্পন্ন শহর উপহার দিতেই ড্যাপ গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের দাবি, সংশোধিত ড্যাপে সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন হলে রাজধানী ঢাকা একটি পূর্ণাঙ্গ মেগাসিটির রূপ পাবে। রাজধানী ঢাকা শত শত বছরের পুরানো শহর। এই শহরকে বসবাস উপযোগী, দৃষ্টিনন্দন ও নাগরিক সুবিধার আধারে পরিণত করতে ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান (১৯৯৫-২০১৫) বা ২০ বছর মেয়াদি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু নানা অসঙ্গতি থাকায় ড্যাপ সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধিত ড্যাপে শুধু জলাশয় বা কৃষিজমি নয়, ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহ সংরক্ষণে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
জানা গেছে, সংশোধিত ড্যাপ অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে এর বাস্তবায়ন কাজ শুরু হবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ড্যাপে নেওয়া সরকারের ১৫ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা মহানগর এলাকায় প্রস্তাবিত ২৮৭টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র, পাঁচটি বৃহৎ আঞ্চলিক পার্ক, ৪৯টি জলকেন্দ্রিক পার্ক, আটটি বৃহৎ ইকোপার্ক (ভাওয়াল বনসহ) এবং ৯টি অন্যান্য পার্ক ও খেলার মাঠ এবং ৬২৭টি স্কুলের বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। যারমধ্যে ইতোমধ্যে সরকার কর্তৃক ১১টি স্কুলের বাস্তবায়নের কাজ চলছে, আর রাজউক কর্তৃক কেরানীগঞ্জে একটি শিশুপার্ক বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
ড্যাপ পরিকল্পনায় আরও রয়েছে প্রস্তাবিত দুটি রিং রোড এবং বৃত্তাকার নৌপথ এবং রিং রোডের সঙ্গে সংযুক্ত র্যাডিয়াল রোড, ফাঁকা ময়মনসিংহ রোডের ট্রাফিকের চাপ কমাতে এর সমান্তরাল প্রস্তাবিত দুটি প্রধান সড়ক (ইস্টার্ন বাইপাসসহ), বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেল দখলমুক্ত করে নান্দনিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে বিনোদনের কেন্দ্রে পরিণত করা এবং ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা সংরক্ষণ করে পর্যটন এবং বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করা। বুড়িগঙ্গা নদীকে ঘিরে পুরো ঢাকার জন সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে। সেই সঙ্গে নৌপথের সমন্বয়ে ব্লু-নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা এবং জলপথকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৫৭৪ কিলোমিটার নৌ চলাচলের উপযোগী নৌপথ উন্নয়ন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আর প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে চিহ্নিত অন্তত ৫০০টি পুকুর খনন করা এবং সেগুলো সংরক্ষণ করা, চিহ্নিত খাল বরাবর অন্তত ৫০০ কিলেমিটার সাইকেল লেন তৈরি করা, চিহ্নিত খাল বরাবর ১ হাজার কিলোমিটার হাঁটার পথ তৈরি করা এবং নির্দেশনা মোতাবেক পাড়ায় প্রায় ১ কোটি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। নিম্নবিত্তের জন্য সাশ্রয়ী আবাসন ৫৪টি লোকেশন বাস্তবায়ন এবং ২৩টি খাল উন্নয়ন প্রকল্প যা দখলমুক্ত এবং সংস্কার করে নান্দনিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ড্যাপে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল ওয়ার্ডভিত্তিক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলো অবাস্তব। কারণ ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে এসব অবকাঠামো করতে গেলে নতুনভাবে জায়গার প্রয়োজন হবে। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে কোন্দল বাড়বে। আদালত পর্যন্ত গড়ালে এবং বাস্তবায়নকাজে স্থগিতাদেশ এলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। মানুষের হাঁটার জায়গা নির্মাণ করার সুনির্দিষ্ট পরামর্শ রয়েছে। ঢাকার ভেতরে ৫৬৬ কিলোমিটার নদীপথ নতুন করে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা প্রস্তাব ছাড়াও সিএস এবং আরএস রেকর্ড অনুযায়ী খালগুলোকে পুনরুদ্ধার করে ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করার কৌশল আছে এবারের ড্যাপে। এ নিয়েও জটিলতা রয়েছে, আদালতে মামলা রয়েছে। বড় বড় অবকাঠামো সরিয়ে নেওয়াও অসম্ভব।
এ ছাড়া মেট্রোরেলকে কেন্দ্র করে টিওডি জোন বা ট্রানজিট অরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট জোন করার প্রস্তাব রয়েছে। পুকুরগুলোকে পুনরুদ্ধার করে জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রস্তাবের পাশাপাশি ঢাকার আশপাশে বয়ে চলা নদীর তীরে ওয়াকওয়ে নির্মাণের প্রস্তাব রয়েছে। প্রশস্ত সড়ক ও ফুটপাত নির্মাণ করে সেগুলোর পাশে গাছ লাগিয়ে নাগরিকদের পূর্ণাঙ্গ আরবান লাইফলাইনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প অনেকাংশেই বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন তারা। রাজধানীর অদূরে আশুলিয়ার বাসিন্দা খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, শুনেছি এ ধরনের একটি পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরাতো বাপ-দাদার ভিটায় থাকি। এগুলো যদি বদলে দিতে হয়, তাহলে তো আমাদের পথে বসতে হবে। জানি না সরকারের পরিকল্পনায় কী আছে। তবে স্থানীয় অনেকেই এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে। আমরা আমাদের পরিবেশে আমাদের মতো করে বাস করতে চাই। আমরা সরকারের কাছে সেই সুযোগ চাই। প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম জানিয়েছেন, এবার ড্যাপের ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করছি, যাতে মানুষ তার নিজের ও আশপাশের ভূমির ব্যবহার ও পরিকল্পনা সম্পর্কে মুহূর্তেই জানতে পারবেন। সংশোধিত ড্যাপে সড়ক, নৌপথ ও রেলপথকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আগের ড্যাপে কৃষিজমি কিংবা জলাশয় সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগ ছিল না। এবার টিডিআর পলিসির (ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইটস) প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি এতে বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মতামত নেওয়া হয়েছে। জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম জানিয়েছে, আশা করছি সংশোধিত ড্যাপ নিয়ে আর কোনও আপত্তি থাকবে না। সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নেওয়া হয়েছে। সেই ভিত্তিতেই ড্যাপ সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধিত ড্যাপে সবাই উপকৃত হবেন বলে আমার বিশ্বাস।
তিনি জানান, রাজধানীতে স্বল্পগতির যানবাহন যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ। আমরা গণপরিবহনকে এই শহরে প্রাধান্য দিচ্ছি। বাসরুট রেশনালাইজেশনের কাজ চলছে। ঢাকার ভেতরে পাঁচটি মেট্রো লাইন ও দুটো বিআরটি লাইনের প্রস্তাব রয়েছে ড্যাপে। ঢাকার যানজট নিরসনে তিনটি রিং রোড এবং ঢাকার খালগুলো পুনরুদ্ধার করে সেগুলো দিয়ে যাতায়াত ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে রাজধানীর চেহারা বদতলে যাবে বলেও জানান স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম।