লাকসামে প্রকাশ্যে জামায়াত নেতাকর্মীদের ঘরবাড়ী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, কোটি টাকার মালামাল লুট
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:০৯ এএম, ১২ সেপ্টেম্বর,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ০৮:০০ পিএম, ৪ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
গত ৮ সেপ্টেম্বর (বুধবার) দিনভর একযোগে লাকসামে প্রকাশ্য দিবালোকে জামায়াতে ইসলামী ও শিবির নেতাকর্মীদের ঘরবাড়ী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হসপিটাল, স্কুল সহ প্রায় ৫০ টির বেশী স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, নগদ টাকা সহ কয়েকশ কোটি টাকার মালামাল লুট করেছে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী।
সম্প্রতি রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে দীর্ঘদিন পর গত মঙ্গলবার সকাল ১০টায় লাকসাম পৌরশহরস্থ ব্যাংক মোড় এলাকা থেকে স্থানীয় জামায়াত নেতাকর্মীরা একটি ঝটিকা মিছিল বের করে। লাকসাম বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী ও পথচারী সুত্রে জানা যায়, শতাধিক জামায়াত নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে আকস্মিক বিক্ষোভ মিছিলটি খুবই অল্প সময়ের মধ্যেই লাকসাম পুরাতন বাসষ্টান্ডে (বর্তমান সিএনজি ষ্টেশন) গিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি, সারাদেশের নেতাকর্মীদের উপর হামলা মামলা সহ বর্তমান সরকারের দমন নীপিড়নে অতিষ্ঠ জাতীয় রাজনীতিতে কোনঠাসা থাকা জামায়াতে ইসলামীর লাকসাম উপজেলা ও পৌরসভা ইউনিটের আকর্ষিক এই বিক্ষোভ মিছিলের পরদিন বুধবার সকাল ১১টার পর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে কিছু সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সমগ্র লাকসাম শহর এলাকায় ভয়াবহ তান্ডব চালায়। দিন থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত সশস্ত্র ওই একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনীর নারকীয় তান্ডবে মুহুর্তেই লাকসাম বাজার জনশুন্য হয়ে যায়। হঠাৎ দোকানপাট বন্ধ হয়ে দিনের আলোতে লাকসাম শহর একটি ভুতুরে নগরীতে পরিনত হয়।
সন্ত্রাসীরা ওইদিন (বুধবার) লাকসামে জামায়াতের সাবেক এবং বর্তমান নেতা অথবা জামায়াতের সাথে নুন্যতম সংশ্লিষ্টতা আছে এমন প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, নগদ টাকা সহ কয়েকশ কোটি টাকার মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায় বলে স্থানীয় জামায়াত নেতাদের সুত্রে জানা যায়। পাশাপাশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা দোকানে থাকা তাদের কর্মচারীদের ব্যপক মারধর ও নানান ধরনের দেশীয় এবং আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। সন্ত্রাসীদের একতরফা এই সহিংসতায় প্রায় ১৫ জন আহত হয়।
সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী ওইদিন প্রকাশ্য দিবালোকে লাকসামের একমাত্র বিশেষায়িত হসপিটাল সুরক্ষা, লাকসাম ডায়াগনস্টিক সেন্টার, লাকসামের স্বনামধন্য চিকিৎসক ডা. আব্দুল মবিনের চেম্বার, লাকসাম ব্যাংক রোডে অবস্থিত মুদি মালামালের পাইকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নুরুন্নবী ষ্টোর, লাকসামের সর্ববৃহৎ বিপনি বিতান চাঁন মিয়া টাওয়ারের কলাপাতা ফ্যাশন, তানজিনা ফ্যাশন, লাকসাম পৌরসভা জামায়াতের আমীর জয়নাল আবেদীনের ওয়ার্কসপ সহ লাকসাম বাজারে থাকা জামায়াত নেতাকর্মীদের কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ভাংচুর, মালামাল ও এসব প্রতিষ্ঠানের ক্যাশে থাকা নগদ টাকা লুট করে নিয়ে যায়।
অগ্নিসংযোগ করে লাকসামের স্বনামধন্য দুটি বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্যামব্রিয়ান স্কুল এন্ড কলেজ ও ক্রিসেন্ট মডেল স্কুলে। এসময় এসব স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের বহনকারী একাধিক মাইক্রোবাসও পুরোপুরি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। লাকসামে জামায়াতের শীর্ষনেতা সাবেক উপজেলা ভাইসচেয়ারম্যান সৈয়দ সরওয়ার সিদ্দীকির লাকসাম পৌর এলাকার মধ্যলাকসামের বাড়ী ও পশ্চিমগাঁও নিবাসী জামায়াত নেতা দেওয়ান খোকনের বাড়ীতেও ব্যাপক ভাংচুর করে সন্ত্রাসী ওই বাহিনী।
দক্ষিন কুমিল্লার অন্যতম বানিজ্যিক নগরী ঐতিহ্যবাহী লাকসাম দৌলতগঞ্জ বাজারে সশস্ত্র ক্যাডারদের ভয়াবহ এমন তান্ডবের পর গত কয়েকদিন যাবত লাকসাম পৌরশহর অনেকটাই থমথমে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউই ঘর থেকে বের হচ্ছেনা। আতঙ্কিত জামায়াত নেতাকর্মীরা সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কাউকেই লাকসাম বাজারের কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। এ ঘটনার পর লাকসামের সাধারণ জনগনের মাঝে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
দক্ষিন কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী লাকসাম দৌলতগঞ্জ বাজারের একাধিক ব্যবসায়ীরা এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভয়াবহ এই তান্ডবের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী লাকসাম বাজারের সাধারন ব্যবসায়ী, রিক্সাচালক ও পথচারীরা তাদের প্রতিক্রিয়ায় এই ঘটনায় বর্তমান সরকারী দল আওয়ামী লীগের অঙ্গসংঠন সমুহের নেতাকর্মীদের দায়ী করে বলেন, "জীবদ্দসায় আমরা লাকসাম বাজারে হামলা, ভাংচুর, প্রকাশ্যে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের মত এমন ভয়াবহ তান্ডব আগে কখনো দেখেনি। একটি গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দেশে সকলের রাজনীতি করার অধিকার থাকলেও আমাদের জানামতে গত বেশ কয়েকবছর যাবত লাকসামের কোথাও কোন রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড দৃশ্যমান নয়।
লাকসামের আওয়ামী লীগ তাদের প্রতিপক্ষ দলের কাউকে রাস্তায় নেমে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়াতো দুরের কথা, ক্ষমতার প্রভাব আর নিজেদের সন্ত্রাসী বাহীনি দিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের রাজনীতিতে নিরুৎসাহীত করার হীন উদ্যেশ্যে গত কয়েকমাসে বিরোধী পক্ষের অনেক সিনিয়র নেতাদের বাসাবাড়ী এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও গিয়েও তারা হামলা ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে। শান্তিকামী লাকসামবাসীর সবই জানা আছে। এসব অনৈতিকতা, এসব অন্যায় অবিচার লাকসামের জনগন আর খুব বেশীদিন সহ্য করবেনা। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে লাকসামবাসী শিগগিরই ঐক্যবদ্ধ হয়ে অবশ্যই অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াবে।"
নাম প্রকাশ না করার নিশ্চয়তা পেয়ে লাকসাম বাজারের আতঙ্কিত এবং ক্ষুব্ধ সাধারণ ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, "যেখানে সরকারের বিরোধী পক্ষের উল্লেখ করার মত রাজনৈতিক কোন কর্মসুচী নেই, আন্দোলন সংগ্রাম নেই, সেখানে সরকারী দলের নেতাকর্মীরা কোন আতঙ্কে এসব পৈশাচিকতা চালাচ্ছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমাদের শান্তির শহর লাকসামে এসব নারকীয় তান্ডবে আমরা রীতিমত আতঙ্কিত। আমরা কে কোন দল করি সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে আমরা সবাই মানুষ। আর মানুষ মানুষের জন্য। আজকে তারা যা করছে তা কোন অবস্থাতেই মানুষের কাজ হতে পারেনা। গত বুধবার দিনভর লাকসামে একতরফা ভাবে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের এমন তান্ডবে আমরা বিস্মিত, আমরা আমাদের জানমাল নিয়ে শঙ্কিত।
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ওইদিন আমরা প্রস্তুত ছিলামনা, তবে ভবিষ্যতে আমরা আর কাউকে ছাড় দেবনা। আমরা প্রয়োজনে রাস্তায় নামবো। একজন লোক সরকারের প্রতিপক্ষ দলে রাজনীতি করার কারনে তার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হবে, তার ঘরবাড়ী, হসপিটাল, স্কুল, কলেজ বা চেম্বারে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট হবে এটা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায়না। আমরা সাধারন ব্যবসায়ীরা এমন জঘন্য তান্ডবের নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার চাই। আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং আমাদের নিজেদের নিরাপত্তা চাই।
ঐতিহ্যবাহী লাকসাম দৌলতগঞ্জ বাজারে অতীতের ন্যায় সকলের সহাবস্থান চাই। নির্বিঘ্নে নির্ভয়ে ব্যবসা করতে চাই। আমরা আশা করবো লাকসামের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা লাকসাম বাজারে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে নিরপেক্ষ, সকলের নিকট গ্রহনযোগ্য ও সহায়ক ভুমিকা পালন করবেন। প্রজাতন্তের কর্মচারী হিসাবে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করবেন"।
লাকসাম বাজারে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ এই তান্ডবের ঘটনায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত থানায় কোন অভিযোগ হয়নি। পুলিশ বলছে, "আমরাও আপনার মত শুনেছি। তবে এখন পর্যন্ত কোন অভিযোগ পাইনি, অভিযোগ পেলে অবশ্যই আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেবো"।
অপরদিকে ঘটনার পরদিন বৃহস্পতিবার লাকসাম উপজেলা ও পৌরসভা আওয়ামী লীগ যৌথভাবে লাকসাম শহরের ব্যাংক মোড়ে শহরের প্রধান সড়কটি দীর্ঘসময় বন্ধ রেখে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। সভায় বক্তারা বিএনপি-জামায়াতের নৈরাজ্য, ষড়যন্ত্র এবং অবৈধ পন্থায় ক্ষমতায় যেতে মরিয়া দেশ ও জাতির অভিন্ন শত্রু এই দুই অপশক্তির সকল কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য লাকসামবাসীকে আহবান জানান। সমাবেশে বিএনপি জামায়াত কতৃক দেশের চলমান উন্নয়ন বিরোধী কর্মকান্ডও প্রতিহত করার ঘোষনা দেয় লাকসামের আওয়ামী লীগ নেতারা।
ভয়াবহ এই তান্ডবের বিষয়ে লাকসাম পৌরসভা জামায়াতের আমীর জয়নাল আবেদিন দিনকালকে বলেন, আমরা আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে শান্তিপূর্ণ মিছিল করেছি গত মঙ্গলবার। আমরা জানমালের ক্ষতি হয় এমন কোন কাজ করিনা। নেতাদের মুক্তির দাবীতে আমাদের মিছিলটি ছিল শতভাগ শান্তিপূর্ন। আমরা কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিনাই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তার পরেরদিন বুধবার সকাল থেকে লাকসামে কিছু সন্ত্রাসী হঠাৎ করে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হসপিটাল, দোকানপাট ভাঙচুর করে মালামাল ও নগদ টাকা লুটপাট করে নিয়ে যায়।
আমরা প্রশাসনের দ্বারস্থ হলেও প্রশাসন আমাদেরকে কোনো সহযোগিতা করে নাই। ভয়াবহ এই সন্ত্রাসী তান্ডবে নগদ টাকা সহ আমাদের কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদ লুটপাট ও নষ্ট করা হয়েছে। এই ঘটনায় আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় ১৫ জন মালিক/কর্মচারীদের আহত করা হয়েছে। তারা সকলেই এখন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমরা বিশ্বাস করি সন্ত্রাসীরা কোন দলের হতে পারেনা। যারা গত বুধবার লাকসামে এমন ভয়াবহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও লুটপাট করেছে তাদের অনতিবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার জন্য লাকসামের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি জোর দাবী জানাচ্ছি।