মিত্রদের নিয়ে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে চায় বিএনপি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:৪২ পিএম, ১০ ফেব্রুয়ারী,শুক্রবার,২০২৩ | আপডেট: ১২:০১ এএম, ৮ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
এখনই সরকার পতনের চূড়ান্ত কর্মসূচিতে না গিয়ে মিত্রদের নিয়ে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে চায় বিএনপি। তৃণমূল থেকে জনমত সংগঠিত করে সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে বড় রকমের চাপ সৃষ্টি করাই দলটির লক্ষ্য। সেই কৌশল বিবেচনায় রেখেই সাজানো হচ্ছে আন্দোলনের কর্মসূচি।
১১ ফেব্রুয়ারি ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রার পর পর্যায়ক্রমে উপজেলা, জেলা ও মহানগরে পালন করা হবে নতুন কর্মসূচি। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শেষ পর্যায়ে ঢাকাকেন্দ্রিক বড় কর্মসূচি থেকে সরকার পতনের ডাক দেওয়া হতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর আজ ১৭ বছর ধরে নানা চড়াই-উতরাই পার করছে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত দলের নেতাকর্মীরা। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অসুস্থ। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বিদেশে। তবে তার দিকনির্দেশনা নিয়েই চলছে দলীয় কর্মকাণ্ড। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার যাতে আরেকবার ক্ষমতায় আসতে না পারে—এবার জোরালোভাবে সেই চেষ্টা করবে বিএনপি। সে লক্ষ্য সামনে রেখেই গত বছরের আগস্ট থেকে সারা দেশে আন্দোলনের কর্মসূচি শুরু করে দলটি। আন্দোলনে নতুন মাত্রা আনতে পুরোনো ২০ দলীয় জোটের পরিবর্তে সমমনা দলগুলো সঙ্গে নিয়ে ১০ দফা দাবিতে ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। এই ধারায় এরই মধ্যে ৫টি কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। ১১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে ষষ্ঠ ধাপের ‘পদযাত্রা’ কর্মসূচি হবে।
এর পাশাপাশি ‘ন্যূনতম দফা’র ভিত্তিতে একটি যৌথ ঘোষণা চূড়ান্ত করতে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে বিএনপি।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের ভেতরে মূল্যায়ন হলো, জনস্বার্থ ইস্যুতে আন্দোলনসহ বেশকিছু কারণে বিএনপিকে নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় রাজনীতিতে তারা আর কোনো ভুল করতে চায় না। বরং অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সমমনা দল ও জোটকে সঙ্গে নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে সামনে অগ্রসর হওয়ার লক্ষ্য তাদের।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা সব মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের কর্মসূচিতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে। কেননা এটি শুধু বিএনপির একার আন্দোলন নয়। এটি আমাদের জাতির অস্তিত্ব ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলন। সেই লক্ষ্যেই আমরা ১০ দফা ও ২৭ দফা প্রণয়ন করেছি। এর মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ প্রমাণ করেছে, তারা একটি দাবিতে আন্দোলন করছে। সেটি হলো—এই অবৈধ ভোটারবিহীন সরকারের পদত্যাগ। আমরা বলছি, অনির্বাচিত সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে পারে না। সম্প্রতি ৬ উপনির্বাচনে তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং কথা পরিষ্কার—আমরা এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ধীরে ধীরে চলছি। ইউনিয়ন থেকে পদযাত্রা শুরু করব। এরপর উপজেলা-জেলা-মহানগরেও যাব। এভাবে সরকারের ক্ষমতার মসনদ জনগণ দখল করবে এবং জনগণের সরকার গঠন করবে। আমরা আন্দোলনের মাধ্যমেই ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে সত্যিকারের একটি জনগণের রাষ্ট্র বানাতে চাই।’
বিএনপি নেতারা জানান, গতানুগতিক রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে ভিন্ন কৌশলে এগোচ্ছেন তারা। রাজপথে তাদের শক্ত অবস্থান তৈরির চেষ্টা করছেন। অবিলম্বে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করছে। এবার বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে আছে ৩৮টি দল ও ১৫টি সংগঠন। যুগপৎভাবে গত ২৪ ডিসেম্বর ৯টি বিভাগীয় শহরে এবং ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণমিছিল, ১১ জানুয়ারি সারা দেশে গণঅবস্থান কর্মসূচি, ১৬ ও ২৫ জানুয়ারি সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ, ৪ ফেব্রুয়ারি বিভাগীয় সমাবেশ করেছে বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোটগুলো। এখন ১১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে ষষ্ঠ ধাপের কর্মসূচি হিসেবে ‘পদযাত্রা’ করা হবে। তবে দ্বিতীয় ধাপের গণঅবস্থান কর্মসূচিতে ছোট দল ও জোটের লোকসংখ্যা কম হওয়ায় সরকারি দলের সমালোচনায় অস্বস্তিতে পড়ে বিএনপি। এ নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটিতেও সমালোচনা হয়েছে। সেইসঙ্গে প্রথম কর্মসূচির পর দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যোগাযোগ না হওয়ায় বিএনপির প্রতি জামায়াত ক্ষুব্ধ। এ অবস্থায় চলমান যুগপৎ আন্দোলন-কর্মসূচির সফলতার ফসল ঘরে তোলাটা বিএনপি ও মিত্রদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী কালবেলাকে বলেন, ‘ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠাসহ কিছু দাবিতে চলমান আন্দোলন ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছে। যুগপৎ আন্দোলন আরও বৃহৎ পরিসরে রূপ নেবে। এভাবে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই সরকারের পরাজয় হবে। যারা এই আন্দোলনে থাকবে না তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।’
তিনি বলেন, ‘দেশে শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ও রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে বিরোধীর পক্ষ থেকে রূপরেখা দিয়ে আমরা গণতান্ত্রিকভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছি। যে কারণে এ সরকার চরম ভয় পেয়েছে এবং বিরোধীদের কর্মসূচির দিন তারা পাহারাদারের কর্মসূচি পালন করছে, যা তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের বহিঃপ্রকাশ।’
চাল, ডাল, জ্বালানি তেল, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, চলমান আন্দোলনে বিভিন্ন স্থানে ৯ নেতাকর্মী হত্যার প্রতিবাদ, খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে ২০২২ সালের ১২ অক্টোবর থেকে বিভাগীয় গণসমাবেশের ঘোষণা দেয় বিএনপি। যদিও গত বছরের ২২ আগস্ট থেকেই জেলা-উপজেলায় বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে দলটি। সরকারি দল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রাম, ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহ, ২২ অক্টোবর খুলনা, ২৯ অক্টোবর রংপুর, ৫ নভেম্বর বরিশাল, ১২ নভেম্বর ফরিদপুর, ১৯ নভেম্বর সিলেট, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লা, ৩ ডিসেম্বর ও ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণসমাবেশ করেছে বিএনপি। যদিও ঢাকার সমাবেশের স্থান নিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির নেতাকর্মীর সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে একজন নিহত ও অনেকে আহত হন। সিনিয়র নেতারাসহ প্রায় সাড়ে ৪০০ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল এবং দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। আমাদের লক্ষ্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, শেখ হাসিনার পদত্যাগ, সংসদ বাতিল করা। সেইসঙ্গে নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন করা। যে নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারবেন। আজকে এই সরকারের প্রতি দেশের ৯৫ ভাগ মানুষের আস্থা নেই, যা গত ১ ফেব্রুয়ারি ৬টি আসনের উপনির্বাচনে ফের প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার লুৎফর রহমান বলেন, আমাদের আন্দোলনের গন্তব্য হচ্ছে সরকারের পদত্যাগ। আমি ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের আলামত দেখতে পাচ্ছি। এখন আমাদের কর্মসূচি ১০টায় শুরু হলেও জনগণ ৮টার মধ্যেই চলে আসছে। এখন চাইলেও জনগণকে আটকানো যাবে না। কারণ দেশের অধিকাংশ মানুষ এই সরকার আর দেখতে চায় না।
১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাৎ হোসেন সেলিম কালবেলাকে বলেন, বিএনপির বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ ছিল যে, নেতারা এসি রুমে বসে রাজনীতি করেন। সেই জায়গায় কিন্তু বিএনপি এখন নেই। বিএনপির টপ টু বটম সবাই এখন সারা দেশে চষে বেড়াচ্ছেন। সেইসঙ্গে সমমনা দল ও জোটগুলোকেও একই প্ল্যাটফর্মে এনেছে। এখন সবাই এই ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ এবং আন্দোলন কর্মসূচিতে সক্রিয়। এটিই বিএনপির অনেক বড় সফলতা। সেইসঙ্গে দেশবাসীও বিএনপির দিকে মুখিয়ে আছে যে, এবার পরিবর্তন হবে। কারণ, দেশের অস্তিত্বের স্বার্থে পরিবর্তনটা অত্যন্ত জরুরি।
গত বছরের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে ১০ দফার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলনের নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। এরপর গত ১৯ ডিসেম্বর ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ হিসেবে ২৭ দফা ঘোষণা দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। মূলত বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ঘোষিত ১৯ দফা ও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঘোষিত ‘ভিশন ২০৩০’-এর আলোকেই উক্ত ২৭ দফা ঘোষণা করা হয়েছে।
বিএনপির নেতারা জানান, বিএনপি ও অন্য দল ও জোট যেসব দাবিতে আন্দোলন করছে, তা অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং যৌক্তিক। মূলত এই সরকার পরিবর্তন করে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তারাই ২৭ দফার আলোকে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কার করবে। এই রূপরেখার আলোকেই বিএনপি বাংলাদেশকে নির্মাণ করতে চায়। সেই যাত্রায় দল মতের ঊর্ধ্বে উঠে সবাই সম্পৃক্ত হবেন বলে তাদের প্রত্যাশা। এরই মধ্যে তাদের যুগপৎ আন্দোলনে ছাত্রসমাজ, জনগণ, গণতান্ত্রিক-দেশপ্রেমিক এবং অন্য দল ও জোট শরিক হয়েছে। তারা যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে দেশবাসীকে আলো দেখানোর ইতিহাস সৃষ্টি করবে।