সবাই আপনাদের মুলা দেখায়
প্রকাশ: ০২:৩৬ এএম, ২৬ জুন,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:৫৩ পিএম, ২ অক্টোবর,
বুধবার,২০২৪
বড় দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বলেছেন, টিকার নামে সবাই আমাদের মুলা দেখায়ে যাচ্ছে। ভেকসিন একটা মজার জিনিস। সাংবাদিক, সাহিত্যিক, গায়ক ব্যবসায়ী সবাই টিকা ব্যবসায়ী বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে তিনি গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, সবাই এখন ভেকসিন ব্যবসায়ী। সবাই আমাদের কাছে বিক্রির জন্য আসছে। মন্ত্রী বলেন, এক মজার কাহিনী বলি, আমেরিকার অনেক ব্যক্তিবিশেষ আমাদের জানিয়েছেন যে, অমুক লোক অনেক টিকা দিতে পারবেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, আমেরিকার লোক বলেছে, তারা রাশিয়ান টিকার ডিলারশীপ পেয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার সরকার আমাদের জানিয়েছে যে, তাদের কোনো ডিলারই নাই।
টিকা কবে নাগাদ পাওয়া যেতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, টিকার সুখবর পাবো। কিন্তু কবে পাবো, সেটি এখন বলতে পারছি না। পৃথিবীর ধনী সাতটি দেশ অর্থাৎ জি-সেভেন একশ কোটি টিকা দেবে বলে আমাদের জানিয়েছে। কিন্তু দেয়ার কথা কেউ বলছে না। শুধু আশ্বাস দিচ্ছে। মন্ত্রী বলেন, ধনী দেশগুলো টিকা নিয়ে বসে রয়েছে। তাদের যত জনসংখ্যা তার থেকে তাদের টিকা বেশি রয়েছে। টিকা এখন অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। অনেকে বলে যে দেবো কিন্তু কেউ দেয় না। আবার দেয়ার সময় জিজ্ঞেস করে যে, অমুক জিনিসে আমাকে সমর্থন দেবেন কিনা। এখন দেখা যাচ্ছে, এটাকে একটি অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এতেও কি সরকারের বোধোদয় হয়েছে? আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় টিকা ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনার জন্য ইন্ডিয়াকে অগ্রিম পাঁচশ’ কোটি টাকা দিলাম। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দুর্নীতির এক বিশাল খনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সেরাম থেকে সরাসরি টিকা না কিনে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে বেক্সিমকোকে দায়িত্ব দেয়। লক্ষ্য বেক্সিমকোকে কয়েকশ’ কোটি টাকা পাইয়ে দেয়া। পরে হয়তো ভাগ-বাটোয়ারা হতো। কিন্তু সেরাম ইনস্টিটিউট চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে টিকা দিতেই অস্বীকার করে বসলেন। তারা বললো, টিকা তাদেরই দরকার। কিছু টিকা আমরা পেয়েছিলাম। সেগুলো প্রথম ডোজ হিসেবে দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ডোজের টিকা শর্ট। সেরাম সোজা না করে দিল। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বেক্সিমকো টিকা আনার দায়িত্ব পরস্পরের কাঁধে চাপিয়ে আস্তে আস্তে পিছু হটলো।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এখন বলছেন, এ বিষয়ে তাঁর কোনো দায় নেই। তার পরেও তিনি ভিক্ষাপাত্র হাতে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন, বাংলাদেশে যাদের এস্ট্রাজেনেকা টিকা শর্ট সেই কয়েক লাখ টিকা অন্তত ভারত উপহার হিসেবে দিক। আগেও তো তারা কয়েক লাখ টিকা উপহার দিয়েছিলো। ভারত সে প্রস্তাবও অস্বীকার করে বাংলাদেশকে জানিয়ে দেয় যে সেরামের এক ডোজ টিকাও বাংলাদেশকে দেয়া সম্ভব হবে না।
এখন মোমেন সাহেব কি বলবেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে ডিপ্লোমেসি বা কূটনীতি বলে কিছু নেই। ভারত বাংলাদেশের কাছে অসংগত চাহিদা যখন তুলে ধরে, তখন সরকারের নবিশ মন্ত্রীরা সমস্বরে বলতে থাকে ‘ঠিক ঠিক ঠিক’। এই যেমন তিস্তায় এক ফোঁটা পানি না দিয়েও ভারত ফেনি নদীর পানি চাইলো। আমরা বললাম আহা, বেচারারা খাবার পানি চায়, কেমন করে না করি। তিস্তায় পেলাম শূন্য। ফেনিতে দিলাম অর্ধেক। ভারতকে বিনা প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সরকার সবকিছু উজাড় করে দিয়েছে। এমন কি ভারত চাওয়ার আগেই দিয়ে দিয়েছে ট্র্যানজিট করিডোর। এতে ভারতীয় গণমাধ্যমও বিস্ময় প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, না চাইতে ভারতকে সবকিছু উজাড় করে দিয়েছে বাংলাদেশ। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ প্রতিবেশীর কাছে, বিনামূল্যে আত্মবিক্রয় করে দেয়নি। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর বাংলাদেশই সম্ভবত এর একমাত্র উদাহরণ।
লোকে বলে মোমেন সাহেব নাকি কূটনীতিক ছিলেন। কূটনীতির অ-আ-ক-খ বিষয়ে তার কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না। কূটনীতি আসলে ঐ মুলার খেলা। মুলা দেখায়, টিকা দেয় না। এই যে মোমেন সাহেবরা চীনের টিকা নিয়ে এতো কথা বলছেন, কিন্তু সে টিকা-ই বা কই। মোমেন সাহেবদের ভাবখানা এমন যে, মানিব্যাগে টাকা নিয়ে বাজারে গেলাম, বাজার থেকে বিভিন্ন টিকা দরদাম করে প্রয়োজনীয় টিকা ট্রাকে করে ঘরে নিয়ে এলাম। না ব্যাপারটা এতোটা সহজ নয়।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কাছে সবচেয়ে সহজলভ্য “চীনের সিনোভ্যাক্স”। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক কমপক্ষে তিনবার বলেছেন যে, চীনের সিনোভ্যাক্স টিকার জন্য চীনের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু কিছুকাল পরেই বোঝা যায় যে, মিথ্যে কথা। চীনের সঙ্গে কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। এখন জাহিদ মালিক বলছেন, শিগ্গিরই চীনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এ ধরনের লোককে ফকট বলা যায়।
এর আগে চীনের সঙ্গে নাকি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুযায়ী দেড় কোটি ডোজ সিনোভ্যাক্স টিকা ডোজ প্রতি দশ ডলারে কেনার নাকি চুক্তি হয়েছিল। সে চুক্তি ছিল প্রকাশ অযোগ্য। কিন্তু চুক্তির শর্তাদি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় চীন বলছে, বাংলাদেশের সাথে চীনের কোনো চুক্তিই স্বাক্ষরিত হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলছেন, এখন চীন নতুন শর্ত দিচ্ছে। বলছে, টিকা পাবে, তবে আমাদের অনুকূলে এই এই কাজ করতে হবে।
মোমেনের দুঃখের বারোমাইস্যা পুনরায় শুরু হলো। কূটনীতি হাত-হদাই নয়। এটি পরিশীলিত বিজ্ঞান। কূটনীতি বিষয়ে মানুষকে বিস্তর লেখাপড়া করতে হয়। তারপর কূটনীতি জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। এই যে সবাই আমাদের মুলা দেখাচ্ছে কিন্তু যথাযথ কূটনৈতিক জ্ঞান থাকলে আমাদের কেউ-ই মুলা দেখাতে পারতো না। একেবারে শুরু থেকেই আমরা টাকাও দিয়েছি আবার ভিক্ষাপাত্র হতে নিয়েছি। মোমেন বলেছেন, রাশিয়া নাকি তাকে বলেছে, রাশিয়ার নাকি কোনো ডিলারই নেই। এতোদূর যখন বলেছেন, তাহলে তো রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো। এবার মস্কো যান। এই ভালো সম্পর্ক ব্যবহার করে ভালো টিকা স্পুটনিক-ডি কিনে নিয়ে আসুন। অহেতুক আমেরিকা বেড়াতে গিয়েছিলেন কেন? পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। আপনি নিজেই বলেছেন, কেন বেড়াতে গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশই করোনা ভাইরাসরোধী ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করতে পারতো। আমরা তো সব সময় গর্ব করি যে, পাকিস্তানের চেয়ে আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। সেটা বোধকরি দুর্নীতিতে, দেশপ্রেমে নয়। আর সে কারণেই পাকিস্তান তাদের নিজস্ব ভ্যাকসিন ‘পাক-ভ্যাক’ উদ্ভাবন করে গণটিকা দিতে শুরু করেছে। ইরান শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নিজস্ব টিকা উদ্ভাবন করে গণটিকা দিতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে গ্লোব বায়োটেক বাংলাদেশী টিকা উদ্ভাবনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। দরকার ছিল সর্বাত্মক সরকারি সহযোগিতা। সে সহযোগিতা যদি তৈরি করা যেতো///// তাহলে দুর্নীতিবাজদের কি হতো? টিকা প্রতি দুই থেকে চার ডলার মার্জিন ফি তাতে থাকতো? না, থাকতো না। তাহলে বঙ্গ-ভ্যাক্সের কি হবে? অর্থাৎ বঙ্গ-ভ্যাক্সটিকা আলোর মুখ দেখবে না।
সরকার সম্ভবত তা চায়ও না। তারা কেবল কেনাকাটা করতে চায়। আবিষ্কার-উদ্ভাবন চায় না। ফলে মোমেন সাহেব আপনাদের টিকাওয়ালাদের ঠেলা-গুঁতা খেয়েই যেতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
----------------------------------------------------------------------------------------------------------
বাংলাদেশই করোনা ভাইরাসরোধী ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করতে পারতো। আমরা তো সব সময় গর্ব করি যে, পাকিস্তানের চেয়ে আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। সেটা বোধকরি দুর্নীতিতে, দেশপ্রেমে নয়। আর সে কারণেই পাকিস্তান তাদের নিজস্ব ভ্যাকসিন ‘পাক-ভ্যাক’ উদ্ভাবন করে গণটিকা দিতে শুরু করেছে। ইরান শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নিজস্ব টিকা উদ্ভাবন করে গণটিকা দিতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে গ্লোব বায়োটেক বাংলাদেশী টিকা উদ্ভাবনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। দরকার ছিল সর্বাত্মক সরকারি সহযোগিতা। সে সহযোগিতা যদি তৈরি করা যেতো