

মাত্রাতিরিক্ত আমলা নির্ভরতার কুফল
প্রকাশ: ০২:২৯ এএম, ২৫ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:২১ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২৩

সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনার পর বাংলাদেশের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর এক মন্তব্য করে সারা দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় প্রায় ১২০০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এ নিয়েও নাটক কম হয়নি। কিন্তু সে সময় কেউ বলেনি যে, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় আমলারা জড়িত। ঐ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেক অনিয়ম হয়েছিল। দোতলার পারমিশন নিয়ে অপরিকল্পিতভাবে আটতলা করা হয়েছিল। শ্রমিকদের কারখানায় যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। অন্যথায় তাদের চাকরি যাবার হুমকি দেয়া হয়েছিল। মাইকিং করে বাড়িতে বাড়িতে ফোন করে শ্রমিকদের কারখানায় ডেকে আনা হয়েছিল। কিন্তু আগে থেকেই ভবনে ফাটল দেখা গিয়েছিল। আর ভবনটি পরিত্যক্ত করার নোটিশও দেয়া হয়েছিল। সে নোটিশের পর দায়িত্বশীলরা ঐ ভবন থেকে অফিস গুটিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা রানা তখনও সেখানে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আর তারই পরিস্থিতিতে ধসে পড়ে রানা প্লাজা।
রানা প্লাজা ধসের কারণ সম্পর্কে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আলমগীর বলে বসলেন দুনিয়া কাঁপানো কথা। সেদিন বিরোধী দল যারা দেশে হরতাল ডেকেছিল। সে হরতাল হয়নি দেখানোর জন্য রানা প্লাজা চালু রাখা হয়েছিল, সকল বিপদের হুমকি উপেক্ষা করে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আলমগীর বলে বসলেন যে, বিএনপির লোকেরা রানা প্লাজার পিলার ধরে ধাক্কাধাক্কি করায় ভবনটি ধসে পড়েছিল। তার এই বক্তব্যে গোটা দেশের মানুষ স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল। মানুষ প্রশ্ন তুলেছিল, তিনি সেন্সে আছেন তো!
বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্য ইউরোপ আমেরিকার দেশে দেশে রফতানি হয়। রানা প্লাজা ধসের ঘটনার পর সে পণ্য রফতানি সঙ্কটের মুখে পড়ে। আমদানিকারক দেশগুলোতে বাংলাদেশি গার্মেন্ট পণ্য বর্জনের ডাক দেয় তরুণ সমাজ। তারা বিভিন্ন ভবনের পিলারে ধাক্কা দিয়ে ছবি তুলে পোস্ট দিতে থাকে : কই ভবন তো নড়ে না। তাহলে বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেতা কর্মীরা কেমন করে পিলার ধরে ঝাঁকি দিয়ে একটা আস্ত আটতলা ভবন ধসিয়ে দিল।
না, রানা প্লাজা কোনো আমলা নির্মাণ করেনি। কিংবা কোনো আমলাকে সে ভবন নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। ফলে সে যাত্রা আমলাদের দোষারোপ করার কোনো সুযোগ ছিল না। জনাব আলমগীর তার মন্তব্যের জন্য কখনও দুঃখ প্রকাশ করেননি। তিনি ভেবেছিলেন, যদি রানা প্লাজা ধসের জন্য কেষ্টা বেটা বিএনপিকে দায়ী করা যায়, তাহলে তার আসন আরও পোক্ত হবে। মন্ত্রিত্ব চলতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। কিন্তু তা হয়নি। তিনি মন্ত্রিসভা থেকে ছিটকে পড়েন।
তবে তিনি থেমে থাকেননি। পরে ফারমার্স ব্যাংক নামে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। সে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার টাকা তিনি কোথায় পেলেন, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। ঐ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেই তিনি ব্যাংক থেকে লুটপাট শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত ব্যাংকটির বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয় এবং নতুন নামে ব্যাংকটির কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব নেয় সরকার। কিন্তু জনাব আলমগীরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এখনও বেশ আছেন জনাব মহিউদ্দিন খান আলমগীর।
তেমনি ঘটনা ঘটলো প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়ে। দেশের হতদরিদ্র গৃহহীন মানুষদের জন্য এই প্রকল্পের গুরুত্ব আছে, প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের সুবিধাভোগীরা ঘর পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল।
প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের সুবিধাভোগীরা ঘর পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল। কিন্তু বিপত্তি বাধলো অল্প কিছুদিন পরই। অনেকেই ঘরে ওঠার আগেই দেখতে পেলেন যে, ঘরের দেয়ালে ফাটল, ফ্লোর ধসে গেছে, পানিতে ডুবে গেছে ঘর। ফলে ঘরের দখল আছে, থাকবার মতো অবস্থা নেই। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হলো, তদন্ত কমিটি হলো। তারা বিপত্তির কারণ জানালো। কম বাজেট, যথাযথ ভিত্তি নেই, রড নেই, সিমেন্ট নেই। কোনো মতে ইট খাড়া করে ‘ভবন’ ধস তো অনিবার্যই ছিল। |
কিন্তু বিপত্তি বাধলো অল্প কিছুদিন পরই। অনেকেই ঘরে ওঠার আগেই দেখতে পেলেন যে, ঘরের দেয়ালে ফাটল, ফ্লোর ধসে গেছে, পানিতে ডুবে গেছে ঘর। ফলে ঘরের দখল আছে, থাকবার মতো অবস্থা নেই। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হলো, তদন্ত কমিটি হলো। তারা বিপত্তির কারণ জানালো। কম বাজেট, যথাযথ ভিত্তি নেই, রড নেই, সিমেন্ট নেই। কোনো মতে ইট খাড়া করে ‘ভবন’ ধস তো অনিবার্যই ছিল।
এই ভবনগুলো নির্মাণের দায়িত্ব তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের ছিল না। এর দায়িত্বে ছিলেন সরকারের আমলারা। তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের এ দায়িত্ব দিতে প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই সংশয়ে ছিলেন। কারণ তাদের রেকর্ড খুবই খারাপ। যাদেরকে তিনি নৌকা মার্কা দিয়ে নির্বাচিত করে এনেছেন, তাদের অধিকাংশকে এ বি এম মূসার ভাষায় ‘চোর’ বলা যায়। ফলে প্রধানমন্ত্রী আশ্রয়ণ প্রকল্পের সামগ্রিক দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমলাদের। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই আরও বড় ‘চোর’। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নিয়ে যখন দেশের মিডিয়া সোচ্চার, তখন আমলারা ঘুরে দাঁড়ালেন। তারা নতুন যুক্তি খাড়া করলেন এবং প্রধানমন্ত্রীকে ধারণা করে বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো দুর্বল ভিত্তি, রড-সিমেন্ট যা দেয়া, অপরিকল্পিত নির্মাণ প্রভৃতি কারণে ভেঙে পড়েনি বরং কেউ কেউ শাবল-হাতুড়ি দিয়ে ঘরগুলো ভেঙে ফেলেছে এবং আমলাদের ফুসমন্তরে প্রধানমন্ত্রী তা বিশ্বাসও করেছেন।
গত ৯ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধারণা করে, আমলা-নির্ভরতায় বলেছেন যে, কিছু লোক মুজিববর্ষ আশ্রয়ণ প্রকল্প-এর অধীনে তৈরি করা প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর হাতুড়ি-শাবল দিয়ে ভেঙে তা মিডিয়ায় প্রচার করেছে। তিনি বলেন, যারা ঘর ভেঙেছে, তাদের নামের তালিকাসহ তদন্ত প্রতিবেদন হাতে রয়েছে।
তিনি বলেন, সব থেকে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, যখন সিদ্ধান্ত নিলাম প্রত্যেকটা মানুষকে আমরা ঘর করে দেব, কিন্তু দেশের কিছু মানুষ এত জঘন্য চরিত্রের যে, কয়েকটা জায়গায় হঠাৎ দেখলাম ঘর ভেঙে পড়েছে। কোনো কোনো জায়গায় ভাঙা। এসব দেখার পর সার্ভে করলাম, কোথায় কী হচ্ছে। আমরা দেড় লাখের মতো ঘর তৈরি করে দিয়েছি। এর মধ্যে তিনশ’টা ঘর ভেঙেছে। বিভিন্ন এলাকায় কিছু মানুষ গিয়ে হাতুড়ি-শাবল দিয়ে সেগুলো ভেঙে মিডিয়ায় ছবি তুলে দিচ্ছে। তাদের নামধাম অনুসন্ধান চালিয়ে বের করা হয়েছে। আমার কাছে পুরো রিপোর্টটা আছে। গরীবের জন্য করা ঘর কারা ভাঙতে পারে। ছবিগুলো দেখলে বোঝা যায়। তদন্তে নয়টি জায়গায় দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তারপর আমলাদের পক্ষেই কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমি দেখেছি, প্রত্যেকেই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছে। যাদের উপর দায়িত্ব দিয়েছিলাম, ইউএনও-ডিসিসহ সব কর্মচারী অনেকে নিজেরা এগিয়ে এসেছে ঘরগুলো তৈরিতে সহযোগিতার জন্য। যারা ইট তৈরি করে, তারাও এগিয়ে এসেছে। এভাবে সবাই সহযোগিতা করেছে, আন্তরিকতা দেখিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে কিন্তু দুষ্টবুদ্ধির লোকও আছে। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে কষ্টকর। এটা যখন গরীবের ঘর, তখন সেখানে তারা হাত দেয় কীভাবে।
এই সরকারের জন্য, সরকারকে ক্ষমতাসীন করার জন্য আমলারা অনেক কাজ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকবারই বলেছেন যে, আওয়ামী লীগারদের তার চেনা আছে। তারা কে কী করেছেন, তিনি তা অনুপুঙ্খ জানেন। ফলে তার দলের লোকদের প্রতি তার কোনো বিশ্বাস বা আস্থা যে নেই, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভরসা সে ক্ষেত্রে আমলারা বা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। কিন্তু তাদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতা সরকারকে হাস্যকর করে তুলতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com