ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
আদম বেপারিরা দায়ী নয়
প্রকাশ: ০৩:০৪ এএম, ১৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৭:৩৭ পিএম, ১১ অক্টোবর,শুক্রবার,২০২৪
জনশক্তি রফতানি আর তাদের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আয় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি বড় খাত। কিন্তু জনশক্তি যারা রফতানি করেন, বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন, তাদের সুনাম কখনো ছিল না, এখনো নেই। তারা নানাভাবে বিদেশগামী শ্রমিকদের হয়রানি করেন বলে সব সময় অভিযোগ আছে। যে কাজের জন্য তারা লোক পাঠান, কর্মীরা গিয়ে দেখতে পান, সে কাজ নয়, তাদের ভিন্ন কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। যে বেতন দেয়া হবে বলে লোভ দেখান, গিয়ে দেখা যায়, বেতন তার অর্ধেকও নয়। কিন্তু বহু টাকা খরচ করে জমি-জিরাত বিক্রি করে আদম বেপারিদের দিয়ে তারা বিদেশে গেছেন, সে টাকা উসুল করতে কম বেতন ও নিম্নমানের কাজ করতে তারা বাধ্য হন। একবার বিদেশে পাঠিয়ে দিতে পারলে আদম বেপারিরা শ্রমিকদের আর কোনো দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করেন না। উপরন্তু সেখানে দুষ্টচক্রের হাতে পড়ে কখনো কখনো তাদের জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়ে। কখনো কখনো এসব শিক্ষাবঞ্চিত শ্রমিককে জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এ রকম হাজার হাজার করুণ কাহিনী জমা হয়ে আছে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের। কখনো এসব শ্রমিক আমাদের দূতাবাসে প্রতিকার চাইতে গিয়ে গলাধাক্কার শিকার হন। দূতাবাস কর্মচারীরাও তাদের বেধড়ক পিটুনি দিয়ে বিদায় করেন, সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন কমই।
জনশক্তি রফতানিকারকদের সমিতি বায়রার সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বাশার বলেছেন, যেসব মহিলা নির্যাতনের অভিযোগ আনেন, তাদের স্বামীরা তাদের ফেরত আনতে চান। কাফালা ব্যবস্থায় কোনো নারীশ্রমিক যদি তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই দেশে ফিরতে চান, তা হলে রিক্রুটিং এজেন্সিকে তার জায়গায় আরেকজন নারীশ্রমিক পাঠাতে হয়। কিংবা মাথাপিছু দুই হাজার ডলার নিয়োগকর্তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। রিক্রুটিং এজেন্টরা গ্রামাঞ্চল থেকে মেয়েদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে চাকরি নিয়ে বিদেশে যেতে উৎসাহিত করে। সাধারণত এদের রাজনৈতিক শক্তি থাকে। ফলে তারা কখনো শাস্তি পায় না |
জনশক্তি রফতানির আড়ালে চলে আদম পাচার। এখন বিদেশে নারীশ্রমিক পাঠানোর নামে চলছে নারীপাচার, যাদের বিদেশের পতিতালয়ে পতিতাবৃত্তি করতে বাধ্য করা হয়। হোটেলে চাকরি, ড্যান্সবারে কাজ করতে বাধ্য করা হয়, দেহব্যবসায় বাধ্য করা হয়। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। অভিবাসী শ্রমিকরা যখন এরকম পরিস্থিতির শিকার হন, তখন দেশে ফিরে তারা কখনো কখনো থানায় মামলা করেন। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আদম রফতানিকারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তাদের এজেন্টদের গ্রেফতার করে। বল প্রয়োগ করে কিংবা প্রতারণার মাধ্যমে তারা শ্রমিকদের শোষণ করে। দেশের প্রচলিত আইনে সেটা মানবপাচার। আর মানবপাচার গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এখানে মানবপাচারকারীরা ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে, বিমানবন্দরের কর্মচারীদের ঘুষ দিয়ে তাদের কাস্টমস পার করায়। এমনকি সন্ত্রাসবিরোধী ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট গত মাসে পাঁচজন রিক্রুটিং এজেন্টকে গ্রেফতার করেছে। তাদের মধ্যে স্বাধীন ট্যুর ও ট্র্যাভেলসের মালিকও রয়েছেন। এরা ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠাতে বিমানবন্দর কর্মীদের ঘুষ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে শাস্তির সামান্য বিধান থাকায় প্রবাসী শ্রমিকদের নামমাত্র হলেও শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সম্প্রতি সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে রিক্রুটিং এজেন্টদের আর গ্রেফতার করা সহজ হবে না। আদমপাচারকারীদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এখন থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর রিক্রুটিং এজেন্টদের সরাসরি গ্রেফতার করতে পারবে না। তার বদলে প্রতারিত ব্যক্তিকে প্রথমে যেতে হবে জনশক্তি নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোয় (বিএমইটি)। এখানে এ ব্যাপারে দেনদরবার করবে। এ ধরনের দেনদরবারের আলোচনা একাধিকবার ব্যর্থ হলে আইনি ব্যবস্থায় যাওয়া যাবে।
এমনিতেই আদমপাচারের যে ভয়াবহ কাহিনী আছে, সে কাহিনী আরো ব্যাপক বিস্তার লাভ করবে। আদমপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে বাংলাদেশী কর্মপ্রত্যাশীরা ডুবে মরে ভূমধ্যসাগরে। পচে মরে তাদের এজেন্টদের আস্তানায়, পাড়ি দেয় মাল্টায়। বয়স লুকায়। এরা ভুয়া তথ্য দিয়ে পাসপোর্ট বানায়। তারপর প্লেনে চড়িয়ে দিয়ে খালাস। এবার নিজের ভাগ্য নিজে গড়ে নাও। এ সম্পর্কে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ নতুন ব্যবস্থা অনুমোদনের কথা স্বীকার করে বলেছেন, বিদেশে কর্মপ্রত্যাশী শ্রমিকদের এ রকম অভিযোগ আনলে, তাদের প্রথমে যেতে হবে বিএমইটিতে। তারা সিদ্ধান্ত দেবে যে ওই কেসটি আদমপাচার রোধ আইনে বিচার করা যাবে কী যাবে না।
প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে যারা কাজ করেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তে তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তারা বলেছেন, মানবপাচার একটি অপরাধ। এ ধরনের অপরাধ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। বর্তমান সিদ্ধান্তের ফলে মানবপাচারকারীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে। এরা এখন নানাভাবে শ্রমিকবিরোধী সুবিধায় আছে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যে বৈঠক হয়েছে, তাতে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন। আর ছিলেন জনশক্তি রফতানির সাথে জড়িত ব্যক্তিরা। সে বৈঠকের আলোচনার একটি অডিও ক্লিপ হাতে পেয়েছে ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিক। তাতে বিএমইটি মহাপরিচালক শহীদুল আলম বলেছেন, জনশক্তি রফতানি কারকদের এজেন্টদের ধরার জন্য পুলিশের এতটা তৎপর হওয়ার দরকার নেই। যাদের জনশক্তি রফতানির বৈধ লাইসেন্স রয়েছে, তাদের ধরে কেন আদালতে নিতে হবে? মানবপাচার আইন অনুযায়ী কাউকে জোর করে বা প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশে পাঠালেই তা কেবল অপরাধ বলে বিবেচিত হতে পারে।
শহীদুল আলম বলেন, ‘আমরা যদি দেখি, কেউ বারবার একই অপরাধমূলক কাজ করছেন, তবে আমরা নিজেরাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বলব। আমরা ভুক্তভোগীকে বোঝাতে চাই যে, কর্মপ্রত্যাশী বা প্রবাসী কোনো সমস্যায় পড়লে, তারা যেন পুলিশের কাছে না গিয়ে আমাদের কাছে আসে।’ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রধানকেও বলেছেন, এখন থেকে পুলিশ দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না।
এই সিদ্ধান্ত তখনই এলো, যখন মানবপাচারের মামলাগুলো নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। বর্তমানে মাত্র ২.৬ শতাংশ মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। আর মানবপাচারের ভয়ঙ্কর সব চিত্র সামনে আসছে। মানবপাচারের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ভুক্তভোগীদের পাঠানো হচ্ছে আইনগতভাবেই। তারা বিএমইটির ছাড়পত্র ও বৈধ ভিসা নিয়েছেন। এদের মধ্যে গত বছর ১৪ বছর বয়সী উম্মে কুলসুম ও ১৩ বছর বয়সী নদী আখতার সৌদি আরবে চাকরি নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে নির্যাতন করে তাদের মেরে ফেলা হয়। কুলসুমকে সৌদি আরব পাঠিয়েছিল এম এইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। তারাই কুলসুমকে পাসপোর্ট করে দিয়েছিল এবং তার বয়স লিখেছিল ২৫ বছর। ২৫ বছরের কম বয়সী কোনো নারীর বিদেশে শ্রমিক হিসেবে যাওয়ার বিধান নেই। নিয়ম অনুযায়ী বিদেশে গমনেচ্ছু নারীশ্রমিকদের বিএমইটিতে সশরীরে হাজির হতে হয় প্রশিক্ষণের জন্য। তারপর তাদের বিএমইটি কার্ড পাওয়ার কথা। এম এইচ ট্রেডের বিরুদ্ধে তখনো আরো অনেক অভিযোগ তোলেন। ভুক্তভোগীরা জানান, তারা সৌদি আরবে গিয়ে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে গত বছর সেপ্টেম্বরে পুলিশি অভিযানে এম এইচ ট্রেডের মালিককে গ্রেফতার করা হয়। তবে বিএমইটি মনে করে না যে, এর জন্য রিক্রুটিং এজেন্টদের দায়ী করা সঙ্গত। দুটি শিশুর বয়স বাড়িয়ে ২৫ করার জন্যও তাদের দায়ী করা যাবে না। বিএমইটি মহাপরিচালক বলেন, বয়স ঠিক বলছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব পাসপোর্ট কর্তৃপক্ষের, রিক্রুটিং এজেন্টদের নয়। তার মতে, আমাদের দেশের ১৩ বা ৩০ বছরের মেয়েদের দেখতে একই রকম লাগে।
এসব নানা কৌশলে আসলে সব সময় মানবপাচারকারীরা পার পেয়ে যায়। গত বছর মানবপাচার বিরোধী আইনে ৫৩৮টি মামলা হয়েছিল। তার মধ্যে ১৪টির নিষ্পত্তি হয়েছিল। সাজা হয়েছিল মাত্র একটি মামলার। বাকি ১৩ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। এখন ২৪ হাজার ৫৫৯ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগ ঝুলছে। ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের তথ্যে বলা হয়েছে, গত বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে নির্যাতিতা শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে ৬৯ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। ২০২০ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নির্যাতনে মারা গেছেন ৪৭৩ জন মহিলা। এর মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ৫১ জন।
জনশক্তি রফতানিকারকদের সমিতি বায়রার সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বাশার বলেছেন, যেসব মহিলা নির্যাতনের অভিযোগ আনেন, তাদের স্বামীরা তাদের ফেরত আনতে চান। কাফালা ব্যবস্থায় কোনো নারীশ্রমিক যদি তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই দেশে ফিরতে চান, তা হলে রিক্রুটিং এজেন্সিকে তার জায়গায় আরেকজন নারীশ্রমিক পাঠাতে হয়। কিংবা মাথাপিছু দুই হাজার ডলার নিয়োগকর্তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। রিক্রুটিং এজেন্টরা গ্রামাঞ্চল থেকে মেয়েদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে চাকরি নিয়ে বিদেশে যেতে উৎসাহিত করে। সাধারণত এদের রাজনৈতিক শক্তি থাকে। ফলে তারা কখনো শাস্তি পায় না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বৈঠকে বলা হয়, নির্যাতনের ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিকে দায়ী করা ঠিক নয়। কেউ যদি নির্যাতিতা হন, তার দায় নিতে হবে নিয়োগকর্তাকে। তাকে কালো তালিকাভুক্তও করা যেতে পারে। কিন্তু ২০১৯ সালে বাংলাদেশী গৃহকর্মীকে হত্যার দায়ে একজন সৌদি মহিলার মৃত্যুদ- হয়। বাকি সব খালাস। কিন্তু মানবপাচারের দায় তাহলে কে নেবে?
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com