স্কুলের জমি অবৈধভাবে দখল করে মন্দির স্থাপন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৩৪ এএম, ২৩ জুন,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০১:২৪ পিএম, ৩ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় স্কুলের জমি অবৈধভাবে দখল করে ২টি মন্দির স্থাপনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পলাশ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও পূর্ব পলাশ দড়ি-হাওলা পাড়া (দেবালয়ের) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি দখল করে মন্দির স্থাপন করা হয়। এ ব্যাপারে সরজমিনে তদন্তে গেলে বেরিয়ে আসে পলাশ বাজার হাই স্কুলের বিপুল পরিমাণ জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে সর্বজনীন শ্রী শ্রী দুর্গা মন্দির।
এ ব্যাপারে হাই স্কুলের সাবেক সভাপতি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম নরুল ইসলাম চেয়ারম্যানের বড় ছেলে মোঃ নজরুল ইসলাম জানান, আমি সভাপতি থাকাকালীন সময়ে মন্দিরের পাশে স্কুলের পূর্ব পাশের জমিতে দেয়াল ও একটি গেট স্থাপন করেছিলাম। বর্তমানে এগুলো ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে মন্দির স্থাপন করছে। স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক কারুজ্জামান, সিনিয়র শিক্ষক কামাল হোসেন, সিনিয়র শিক্ষক মাহফুজ স্যার জানান, স্কুল বন্ধ থাকাকালীন সময়ে আমাদেরকে না জানিয়ে মন্দির কমিটির লোকজন দেয়াল ও গেট ভেঙ্গে ফেলে স্কুলের জমি অবৈধভাবে দখল করে মন্দির স্থাপন করছে। স্কুলের ভাঙ্গা গেটটি এখন কোথায় জানি না।
মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক শ্রী বাবুল কুমার সাহা বলেন, আমাদের এই মন্দিরের কারো দেয়া কোনো দানপত্র দলিল নেই। তবে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা মৌখিকভাবে মন্দিরের নামে দান করে গেছেন। দানকৃতরা সবাই এখন মৃত। কেউই জীবিত নেই। আমাদের কোনো ওয়ারিশরা এখনও কোনো দানপত্র দলিল দেন নাই। বর্তমানে যে মন্দির নির্মাণ করা হচ্ছে আগের সরকার চার লক্ষ টাকা অনুদান দিয়েছেন। বর্তমানে আরও দশ লক্ষ টাকা অনুদান এসেছে যা দিয়ে মন্দিরের কাজ চলমান।
স্কুল কমিটির সাবেক সদস্য কিরন শিকদার, মনির হোসেন, আওয়ামী লীগের নেতা মনির, পলাশ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্কুল কমিটির সাবেক সভাপতি আব্দুল আলী ভূইয়াসহ অনেকেই বলেন, মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক শ্রী বাবুল কুমার সাহার বক্তব্য সত্য নয়। বাবুল সাহা নিজেই স্কুলের জমিতে ৮টি রুম করে স্কুলের জমি দখল করে রেখছে। ছোট পরিসরে মন্দিরটি আরও ভিতরে ছিল। সম্প্রসারণ করতে করতে মন্দিরটি এখন সম্পূর্ণটাই স্কুলের জমিতে। বাবুল সাহার পূর্ব পুরুষের কারো সম্পত্তি নয় বিদধায় তারা মন্দিরের নামে দানপত্র করতে পারেন নাই।
স্কুলের পাশের বাড়ির কালিপদ দাস খোকা জানান, এখানে মন্দিরের কোনো জমি নেই। স্কুলের জমিতে সব হিন্দুরা মিলে মন্দির বানিয়ে রেখেছে। অনেকেই প্রতিবাদ করে কিন্তু কোনো লাভ হয় নাই। এ ব্যাপারে এলাকার বহু হিন্দু-মুসলিম জানান, পেশি শক্তির জোরে স্কুলের জমিতেই মন্দির করা হয়েছে।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ রফিকুল ইসলামকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি অতি দুঃখের সাথে বলেন, স্কুলের জমি যে যেখান দিয়ে পারছে দখল করে নিয়ে যাচ্ছে দেখার কেউ নাই। স্কুলের শিক্ষকদের সাথে কোনো আলাপ আলোচনা-মিটিং না করে স্কুলের টাকায় নির্মিত গেট এবং দেয়াল ভেঙ্গে স্কুলের জমি অবৈধভাবে দখল করে মন্দির স্থাপন করছে। এ ব্যাপারে আমি স্কুলের সভাপতি ডাঃ সমরেশ বাবুকে বিস্তারিত জানিয়েছি।
পূর্ব পলাশ দড়িহাওলা পাড়া দেবালয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবৈধভাবে জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ৬৫ শতাংশ জমিতে চন্ডি রামাই ঠাকুরের মন্দির। এখানে এক সাথে পাশাপাশি আলাদা আলাদা পাঁচটি মন্দির স্থাপন করা হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে দেবালয় সংস্কৃত কলেজ।
এ ব্যাপারে সরজমিনে গেলে মন্দির ও কলেজের কেয়ারটেকার ভিপিন্দ্র ভৌমিক জানান, আমি শুধু জানি এখানে দুই-আড়াই শ বছরের একটি পুরাতন বট গাছ আছে যা সবাই জানে। মন্দিরের কোনো দলিলপত্র আছে কিনা আমার জানা নেই। বঙ্কিীম চন্দ ধর জানান, মন্দিরের নামে কোনো দলিল-কাগজপত্র নেই। এখানে একটি হাই স্কুল করা খুবই জরুরি।
স্কুলের পাশের বাড়ি ফকির বাড়ির ফারুক খন্দকার বলেন, মূলত এখানে মন্দিরের কোনো জমিই নেই। কৌশলে মন্দির বানিয়ে বহু জমি দখল করে রেখেছে। এখানে একটি হাই স্কুল করা খুবই জরুরি। উক্ত মন্দির স্থাপন করার কারণে হাই স্কুল করাটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে।
পাশের বাড়ির কিবরিয়া ও এই ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বর ও কমিশনারসহ এলাকাবাসী জানান, মন্দির কমিটি কৌশল করে এখানে একটি সংস্কৃত কলেজ করেছেন মন্দির টিকিয়ে রাখার জন্য। মূলত এটি স্কুলের জমি। এখানে একটি হাই স্কুল করা অতীব জরুরি। এ এলাকার দুই-তিন কিলোমিটারের ভিতরে কোনো হাই স্কুল নেই। এ এলাকার ছাত্রছাত্রীদের বহুদূর হেঁটে স্কুলে যেতে হয়।
স্কুলের প্রধান শিক্ষকা প্রমিলা দেবি নাথ জানান, মন্দিরের নামে কোনো দলিল কিংবা পরচা আমার জানা মতে নেই। স্কুলের নামে আরএস পরচায় ২৪৪ শতাংশ জমি আছে।
স্কুলের সভাপতি সঞ্চিত সরকার জানান, স্কুলের নামে কিছু জমির দলিল আছে, আর বাকি জমি আরএস পরচায় আছে স্কুলের নামে। মন্দিরের কোনো দলিলপত্র নাই। ৬৫ শতাংশ জমি মন্দিরের দখলে আছে।
মন্দির কমিটির সভাপতি দীনেশ মাস্টার জানান, এখানে মোট স্কুল ও মন্দির মিলিয়ে স্কুলের নামে ২৪৪ শতাংশ জমি এসএ পরচায় আছে। বর্তমানে স্কুল ও মন্দিরের পুরো জমিটাই শিক্ষা মন্ত্রাণালয়ের নামে আছে। এই জমি সরকার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নামে নিয়ে নেয়। তবে মন্দিরের কোনো দলিল নেই, দাতাও নেই। মন্দিরের দখলে ৬৫ শতাংশ জমি রায়েছে।
তিনি আরও জানান, এক সময় বহু আগে ঢাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক সৈয়দ মাহতাব উদ্দীন এসে উক্ত জমি তার পিতা সৈয়দ মেজবাহ উদ্দীন আহমেদের বলে দাবি করেন। পরবর্তীতে তা টেকে নাই। এই জন্য এলাকার অনেকে বলে থাকেন এই স্কুল ও মন্দিরের জমি মেজবাহ উদ্দীন সাহেবের স্কুলের নামে দানকৃত জমি।
মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক কার্তিক নন্দী জানান, আমি ৩ বছর আগে মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক হয়েছি। আমার জানা মতে মন্দিরের কোনো কাগজপত্র নাই। ঘোড়াশাল পৌরসভা ভূমি অফিসের নায়েব মোঃ আহসান হাবিব জানান, দড়িহাওলা পাড়া পূর্ব পলাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (দেবালয়)-এর জমির পরিমাণ ২৪৪ শতাংশ আরএস রেকর্ডে নথিভুক্ত। মন্দিরের নামে কোনো রেকর্ড বা কাগজপত্র নেই। মন্দিরটি সম্পূর্ণ রূপে স্কুলের জমিতে অবস্থিত। এবং পলাশ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ভিতরে যে মন্দিরটি তারও কোনো রেকর্ড কিংবা কোনো কাগজপত্র নেই। দুটি মন্দিরই স্কুলের জায়গায়। পূর্ব পলাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি (দেবালয়) ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর দেবালয় সংস্কৃত কলেজটি ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।