টাকা আসে খরচও হয় : শুধু বাঁধ টেকে না কয়রায়
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:১৭ পিএম, ২ সেপ্টেম্বর,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০১:৪৯ পিএম, ৪ অক্টোবর,শুক্রবার,২০২৪
টিকে থাকার লড়াইয়ে সুন্দরবন উপকূলীয় কয়রার মানুষ বরাবরই পারদর্শী। তারা এখন ভিটেমাটি রক্ষায় জীবন বাজি রেখে স্বেচ্ছায় বাঁধ নির্মাণে আরও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। সেই সাথে স্বেচ্ছায় বাঁধ নির্মাণের ফাঁকেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। গত ১৪ আগস্ট কয়রার চরামুখা এলাকায় ভেঙে যাওয়া ২০০ মিটার জায়গা মেরামত হয় স্বেচ্ছাশ্রমে। আর সেখানে জিও ব্যাগ, গানি ব্যাগ, বাঁশ ও জিও ফেব্রিক সরবরাহ করে পাউবো। এতেই পাউবোর খরচ ১০ লাখ টাকা। অন্যদিকে বাঁধ ভাঙে, স্বেচ্ছায় কাজ করে হতাশায় ডুবে মানুষ। এ এলাকায় ১ কিলোমিটার জায়গায় বাঁধের জন্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকারও বেশি অর্থের চাহিদা যাচ্ছে মন্ত্রণালয়ে।
এদিকে কয়রার নাগরিক নেতারা বলেন, গত ১০ বছরে জরুরি কাজের নামে কয়রায় বেড়িবাঁধ সংস্কার ও নির্মাণ বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ১৪২ কোটি ৫৮ লাখ টাকারও বেশি। কিন্তু তাতে প্রকৃত পক্ষে কয়রার মানুষের কোনো উপকার হয়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সাতক্ষীরা-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহনেওয়াজ তালুকদার বলেন, গত ৩ বছরে শুধু কয়রায় ৫০ কিলোমিটার বাঁধ মেরামতে ২৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়। তিনি বলেন, কয়রার ১২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতি বছরই ১০-১৫ কিলোমিটার বাঁধ মেরামত করতে হয়। এখানে নদী ভাঙন হয়। ভাঙনে ঘেরের প্রভাব খুব বেশি। এখানে বাঁধ রক্ষায় ঘের বন্ধ করা জরুরি বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সবশেষ ভাঙনে স্থানীয় মানুষ ২ বেলা স্বেচ্ছায় কাজ করেছেন। সেখানে পাউবোর ১০ লাখ টাকা খরচ হয়। সেখানে জিও ব্যাগ, গানি ব্যাগ, বাঁশ ও জিও টেক্সটাইল সরবরাহ করতে এ খরচ হয়। ওই এলাকায় এখনও কাজ চলছে। বাঁধটির ১ কিলোমিটার মেরামতে ১ কোটি ২০ টাকারও বেশি অর্থের চাহিদা রয়েছে। এই কাজটি ১ দশমিক ২৫ মিটার জিও টিউব দিয়ে সম্পন্ন করা হবে।
খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ইঞ্জিনিয়ার জিএম মাহবুবুল আলম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাঁশ ও ব্যাগ স্বল্পতায় ১৪ আগস্টের ভাঙন মেরামত কাজে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড যে সরঞ্জামাদি দিয়েছিল সেটা যথেষ্ট ছিল না।
দক্ষিণ বেদকাশী গ্রামের আক্তারুল ইসলাম বলেন, নদী ভাঙনের কারণে আমার ঘরের ভিতরে পানি ঢুকে পড়েছে। কোথায় থাকবো জানি না। রান্না করার কোনো ব্যবস্থা নেই। বাঁধ না হলে ছেলেমেয়ে নিয়ে কী করবো ভেবে পাচ্ছি না। সে কারণে সব কিছু ফেলে বাঁধ তৈরির কাজে নেমে পড়েছি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. মাসুদ রানা বলেন, ১৪ আগস্টের ভাঙনের পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ১০ গ্রাম। ভেসে যায় তিন হাজার বিঘা চিংড়ি ঘের। পানিবন্দি হয়ে পড়ে ১৫ হাজার মানুষ। ক্রমাগত ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের চরম গাফিলতি রয়েছে।
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, একই স্থানে বারবার ভাঙা দুঃখজনক। কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেই এই ভোগান্তি। সরকার ইতোমধ্যে ওই এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে দ্রুত স্বচ্ছতার সাথে কাজটি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত জনমনে স্বস্তি নেই। কারণ আমরা দেখেছি— বিগত ১০ বছরে জরুরি কাজের নামে কয়রার বেড়িবাঁধ সংস্কার ও নির্মাণ বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে- ১৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৮ হাজার টাকারও বেশি। অথচ সেইসব জোড়াতালিতেও বাঁধ সংস্কারের নামে যেটুকু কাজ হয়, সেখানেও রয়েছে আমলা-কর্মকর্তা-জনপ্রতিনিধি ঠিকাদার মিলিয়ে সরকারি তথা জনগণের অর্থ লুটপাটের অসাধু চক্র। টেন্ডারে কাজ পেয়ে মূল ঠিকাদার নিজের লাভটা রেখে কাজটা বিক্রি করে দেন আরেকজনের কাছে। এভাবে হাতবদল হলে কাজের মান খারাপ হতে বাধ্য- এটাই দেখে এসেছি এতদিন। এবার আর এমনটি চাই না। কয়রার নাগরিক নেতা আরও জানান, কয়রায় নদী ভাঙনের কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে রাস্তাঘাটে, পরের জমিতে কোনোকমে আশ্রয় নেন। অনেকে আবার সর্বস্ব হারিয়ে শহর-বন্দরে পাড়ি দেন, যাদের প্রকৃত হিসাব সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই। শুধু দক্ষিণ বেদকাশী নয়, উপকূলীয় এ উপজেলার প্রায় আড়াই লক্ষাধিক মানুষকে নদীভাঙনের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হয়। একটি টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবিতে এতোদিন কয়রার মানুষ আন্দোলন করে আসছিল। এখন বরাদ্দ হয়েছে, এবার আন্দোলন স্বচ্ছতার সাথে কাজটি বাস্তবায়নের বিষয়টি বুঝে নেয়ার।