ডেঙ্গু টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষায় বড় বাধা ‘অর্থ সংকট’
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭:২৬ পিএম, ৪ অক্টোবর,শুক্রবার,২০২৪ | আপডেট: ০৭:৪৫ পিএম, ১২ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
বর্ষাকালেই সাধারণত ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। যা শীতের আগে কমেও আসে। তবে বাংলাদেশে এখন সেই চিত্র পাল্টে গেছে। ডেঙ্গু এখন আর নির্দিষ্ট কোনো মৌসুমের রোগ নয়। ডেঙ্গুর এখন বর্ষা বা শীত নেই। বরং ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগে পরিণত হয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণে কীটতত্ত¡বিদ বা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময় নানা পরামর্শ দিলেও কার্যত ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসছে না। ২০২৩ সালে ডেঙ্গু সংক্রমণ মহামারি আকার ধারণ করেছিল। ওই বছর দেশে তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। তাদের মধ্যে ঢাকায় এক লাখ ১০ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন দুই লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন। এছাড়া সে বছর ডেঙ্গুতে এক হাজার ৭০৫ জন মারা যান, যা একক কোনো বছরে দেশে ডেঙ্গুরোগে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড।
এডিশ মশার ভয়াবহ এই বিস্তাররোধে গত বছরই ডেঙ্গু প্রতিরোধী টিকার বিষয়টি জোরেশোরে আলোচনায় এসেছিল। ২০২৩ সালেই যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানের আবিষ্কার করা ডেঙ্গু টিকা নিয়ে বাংলাদেশে ‘সফলভাবে ট্রায়াল বা পরীক্ষা’ চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানীরা। এ টিকার একটি ডোজ ডেঙ্গুর চারটি ধরনের জন্যই কার্যকর হবে বলে জানান তারা। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ বা এনআইএইচের আবিষ্কৃত এই টিকার নাম টিভি-০০৫।
আইসিডিডিআরবি জানায়, ডেঙ্গু টিকার দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ ছিল বাংলাদেশে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউভিএম) লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের গবেষকরা এই টিকার সফল পরীক্ষা চালান। পরবর্তীকালে আইসিডিডিআরবি জানায়, ডেঙ্গু টিকার দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা শেষে দেখা গেছে, এটি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রয়োগের জন্য নিরাপদ এবং এটি রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম।
ডেঙ্গু টিকার দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়াল শেষ হয়েছে। ডেঙ্গুর চারটি ধরনের বিপরীতে এই টিকা কার্যকরভাবে কাজ করেছে বলে আমরা দেখেছি। এমনকি এক বছর বয়সীদের শরীরেও এই টিকার ট্রায়ালে ভালো ফল পেয়েছি আমরা।- বিজ্ঞানী রাশিদুল হক। তবে দ্বিতীয় ধাপে সফল ট্রায়ালের পর এই টিকা নিয়ে আলোচনা আর এগোয়নি। দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠান তৃতীয় ধাপে ট্রায়ালের জন্য নতুন করে বিনিয়োগ করেনি বলে জানায় আইসিডিডিআরবির একটি সূত্র। আইসিডিডিআরবির একজন বিজ্ঞানী বলেন, এই ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এরই মধ্যে ভারত ও অন্যান্য দেশে শুরু হয়েছে। তবে তহবিলের অভাবে বাংলাদেশে এটি এখনো শুরু হয়নি। আমরা এখনো ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে অর্থায়নের বিষয়ে প্যানাসিয়া বায়োটেকের (ডেঙ্গুর টিকা নিয়ে কাজ করা ভারতীয় কোম্পানি) সঙ্গে আলোচনা করছি। তবে বাংলাদেশে তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালের বিষয়ে তারা খুব একটা আগ্রহী নয়।
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগে দেখা গেছে, চারটি ধরনের বিরুদ্ধেই এই টিকা অ্যান্টিবডি তৈরিতে সফলতা দেখিয়েছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধী ভ্যাকসিন তৈরি হতে আরও তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে টিকার সফল ট্রায়ালের বিষয়টিকে বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ‘আশাব্যঞ্জক’ বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। জানা যায়, বর্তমানে ভারত ও ব্রাজিলে ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল চলছে, তবে সেটির ফলাফল এখনো তাদের হাতে আসেনি। এনআইএইচের অর্থায়নে বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশে ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। এনআইএইচ এখন পর্যন্ত ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে এই ভ্যাকসিন তৈরির অনুমতি দিয়েছে। চলতি বছরে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) এবং প্যানাসিয়া বায়োটেক ভারতে ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের জন্য প্রথম পর্যায়ে তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সূচনা করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী রাশিদুল হক বলেন, ডেঙ্গু টিকার দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়াল শেষ হয়েছে। ডেঙ্গুর চারটি ধরনের বিপরীতে এই টিকাটি কার্যকরভাবে কাজ করেছে বলে আমরা দেখেছি। এমনকি এক বছর বয়সীদের শরীরেও এই টিকার ট্রায়ালে ভালো ফল পেয়েছি আমরা।
তিনি জানান, অর্থায়নের অভাবে ডেঙ্গু টিকার তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল বন্ধ আছে। ভারতের প্যানাসিয়া বলেছে, আপাতত তারা আমাদের অর্থায়ন দেবে না। এর নির্দিষ্ট কোনো কারণ তারা বলেনি। তবে বলেছে, তাদের টিকাটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেলে সেই টিকা বাংলাদেশকে দেবে। এ কারণেই বাংলাদেশে ডেঙ্গু টিকার তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল আলোর মুখ দেখছে না।
এদিকে গত সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুর ভয়াল রূপ দেখেছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের ৯ মাসের মধ্যে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে সেপ্টেম্বরে। চলতি মাসে ডেঙ্গুতে ৮০ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, যা ৯ মাসের মোট মৃত্যুর প্রায় ৫০ শতাংশ। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মোট মারা গেছেন ১৬৩ জন। অন্যদিকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩০ হাজার ৯৩৮ জন। যেখানে ১৮ হাজার ৯৭ জনই আক্রান্ত হয়েছেন সেপ্টেম্বওে, যা মোট আক্রান্তের প্রায় ৬০ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বছরের প্রথম মাস জানুয়ারি দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন ১০৫৫ জন ও মারা যান ১৪ জন। এরপর ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ৩৩০ জন ও মারা যান ৩ জন; মার্চে আক্রান্ত ৩১১ জন, মারা যান ৫ জন; এপ্রিলে আক্রান্ত ৫০৪ জন, মারা যান ২ জন; মে মাসে আক্রান্ত ৬৪৪ জন, মারা যান ১২ জন; জুন আক্রান্ত ৭৯৮ জন, মারা যান ৮ জন; জুলাইয়ে আক্রান্ত ২ হাজার ৬৬৯ জন ও মারা যান ১২ জন। তবে আগস্ট মাস থেকে দেশে ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বমুখী প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। আগস্টে আক্রান্ত হন ৬ হাজার ৫২১ জন আর মারা যান ২৭ জন। সেপ্টেম্বরে এসে আক্রান্ত আরও বেড়ে ১৮ হাজার ৯৭ জন আর মৃত্যু বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ জনে। ১ জানুয়ারি থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজার ১২১ জনে। চলতি বছর মশাবাহিত রোগটিতে এখন পর্যন্ত প্রাণহানি হয়েছে ১৭৭ জনের।